সকাল থেকে মহীধরবাবু কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছেন না। ডায়েরির পাতায় কিছু লিখতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন বারবার। বাড়ির একটু দূরে, পাড়ার মাঠে একটি রাজনৈতিক দলের মিটিং চলছে সকাল থেকেই। মাইকে এক বক্তার বক্তব্য শুনেই তিনি থমকে যান। সেই বক্তা বলছেন - এই পৃথিবীতে প্রকৃত সাম্যবাদের পথ দেখাতে পারে একমাত্র তাদের দলই। এই পর্যন্ত শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন মহীধরবাবু। একটার পর একটা প্রশ্নের ঢেউ উঠতে লাগলো তাঁর মনে। ভাবতে থাকলেন - প্রকৃত সাম্যবাদী কে ? প্রত্যেকের প্রতি সমমনোভাব দেখানো ও সমআচরণ করা কি সত্যিই কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব ? মানুষ তো নিজেই তথাকথিত কোনো শ্রেনীভুক্ত। তা ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যে শ্রেনীরই হোক না কেন। ভাবতে ভাবতে মহীধরবাবুর মনে এলো, প্রত্যেকটি জীবের প্রতি সম আচরণ করে একমাত্র এই পৃথিবী। অতি ক্ষুদ্র প্রানী থেকে জীব শ্রেষ্ঠ মানুষ, কারোর প্রতি তার আচরণ ভিন্ন হয় না। পৃথিবীর সব সম্পদ, সব সৌন্দর্যই এই পৃথিবীর সব জীবের জন্যে। সেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই সাম্যবাদী ও সাম্যবাদের প্রকৃত পথ প্রদর্শক হল এই পৃথিবী।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বাড়ির লাগোয়া রাস্তা থেকে অনেক লোকের হৈ চৈ, চিৎকার কানে আসে। যদিও কেন এই চেঁচামেচি তা জানেন না মহীধরবাবু, আর জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহও তাঁর নেই। তিনি বিরক্ত হচ্ছেন এই ভেবে যে তাঁর সাধন-কক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েও কাজে হাত দিতে পারছেন না। একবার ভাবলেন বেরিয়ে ধরিত্রীকে জিজ্ঞাসা করবেন ব্যাপারটা। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বাদ দিলেন সেই চিন্তা কারণ ধরিত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে, সে যে কি উত্তর দেবে তার ঠিক নেই; সর্বদাই প্রচণ্ড মেজাজে ফুঁসছে সে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা পড়ে। একবার, দুবার, তিনবার। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খোলেন মহীধরবাবু আর হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকেন ধরিত্রী। অবাক মহীধরবাবুকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে ওঠেন, ‘তাড়াতাড়ি বাইরে চল, ওরা তোমার জন্যে ওয়েট করছে।’ অবাক চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মহীধরবাবু বলে উঠেন, ‘আমাকে বাইরে যেতে হবে ! কেন ? আর কারা ওয়েট করছে ?’ রাগে গা জ্বলে ওঠে ধরিত্রীর, তবু নিজেকে শান্ত করে কাটা কাটা গলায় বলেন, ‘যেতে হবে কারণ পাড়ার লোকেরা একটা সমস্যায় পড়েছে, আর তাই তারা তোমার কাছে এসেছে। বোঝা গেছে ? এবার চল।’ মহীধরবাবুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে আসেন ধরিত্রী। মহীধরবাবু তাকিয়ে দেখেন তার বাড়ীর উঠোনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে দু’একজনের মুখ তাঁর চেনা বলেও মনে হল, কিন্তু এদের সমস্যাটা কি ? তাঁর কাছে কি কারণে এসেছে আর তিনি তাদের সমস্যার সমাধানই বা করবেন কি করে, সে সব কথা তাঁর মাথায় ঢুকল না। তিনি অসহায় ভাবে একবার ধরিত্রীর দিকে আর একবার লোকগুলোর দিকে তাকালেন। তাঁর অবস্থা বুঝে ধরিত্রী বললেন, ‘আমাদের পাড়ার পাশ দিয়ে সরকারি যে ঢালাই রাস্তা চলে গেছে, তার গায়েই রয়েছে অনেকেরই বাড়ির পাঁচিল, কারো কারো দোকানের পাঁচিলও রয়েছে। এতদিন কোনো সমস্যা হয়নি, কিন্তু হঠাৎ করে সরকারি নোটিশ এসেছে যে ঢালাই রাস্তার ধারে পাঁচিল থাকার ফলে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটছে। অতএব সরকার ঠিক করেছে যে রাস্তা চওড়া করা হবে, আর তাই সরকারি জমির উপর যত পাঁচিল বা কনস্ট্রাকশন আছে, সেগুলো ভাঙ্গা পড়বে।’ একসাথে এত কথা বলে ধরিত্রী থামেন আর সেই ফাঁকে আমতা আমতা করে মহীধরবাবু বলেন, ‘সবই বুঝলাম, কিন্তু এ বিষয়ে আমার কি করণীয় সেটা তো –’ কথা শেষ করতে না দিয়ে ধরিত্রী বলে ওঠেন, ‘এখুনি সরকারকে একটা পাল্টা চিঠি দিতে হবে সবাইকে দিয়ে সই করিয়ে যে এরকম হঠাৎ করে যদি পাকা পাঁচিল ভেঙ্গে দেওয়া হয়, তাহলে অনেক মানুষেরই বাড়ি, দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা হতে পারে না আর তোমার চেনাশোনা লোকজন দিয়ে আজই হাইকোর্টের একজন ভাল উকিলকে ঠিক করতে হবে। স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্যে।’ ধরিত্রীর কথা শেষ না হতেই রাজীব বলে ওঠে, ‘স্যার, এটা কিন্তু আপনাকে করতেই হবে; তা না হলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যাব। আপনি খরচের কথা ভাববেন না। কোর্টের খরচ যা লাগে, আমরা সবাই মিলে দেব।’
সবাই মাথা নাড়ে। মহীধরবাবু চশমাটা খুলে হাতে নেন, তারপর শান্ত স্বরে বলেন, ‘দেখুন, প্রথম কথা হাইকোর্ট কেন, কোন কোর্টেই আমার এমন কোনো চেনা লোক বা এ্যাডভোকেট নেই; আর দ্বিতীয় কথা, যদিও আসলে সেটাই প্রথম কথা যে সরকারি ঢালাই রাস্তার ধারে যে সব পাঁচিল তোলা হয়েছে, সেই জায়গাটাও তো সরকারেই। কারোর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নয়। সুতরাং সরকারের অধিগৃহীত জমিতে কোনো পাকা কনস্ট্রাকশন করা যায় না, আর এটাও তো অত্যন্ত সত্যি যে রাস্তার তুলনায় যানবাহন ও মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেক, অনেকগুণ। তাই রাস্তা একেবারে সংকীর্ণ হয়ে গেছে, আর তাই যানজট আর অ্যাকসিডেন্টও নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তা তো বড় না করলেই নয়। দেখুন, আইন, আদালত করে হয়ত সাময়িকভাবে সরকারি কাজকে আটকে দেওয়া যায়। কিন্তু বরাবরের জন্যে কখনোই নয়, আর আমাদেরই ছেলে-মেয়ে আত্মীয় পরিজন তো প্রতিদিন এই পথেই যাতায়াত করে, যদি তাদের কিছু ঘটে যায় ? অন্য একটা দিকও কিন্তু আছে। ঢালাই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন অনেক ভারী গাড়ী যাতায়াত করে। তাদের জন্য রাস্তার গা লাগোয়া পাঁচিলে কিন্তু ফাটল ধরে যে কোনো মুহূর্তে পাঁচিল ভেঙ্গে বড় বিপদ ঘটতে পারে। এগুলো কখনো ভেবেছেন আপনারা? আমাদের সবার স্বার্থে, বৃহত্তর স্বার্থে, সরকারি এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। বাকিটা আপনাদের বিবেচনা।’ এই বলে ধীর পায়ে তাঁর সাধন কক্ষে ঢুকে মহীধরবাবু দরজা বন্ধ করে দেন।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ধরিত্রী আর উঠোনে জড়ো হওয়া লোকজন।