।। দশম।।

    সকালবেলা নিয়ম করে বাংলা খবরের কাগজ আসে মহীধরবাবুর বাড়িতে, কিন্তু নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়াটা একেবারেই হয়ে ওঠে না মহীধর বাবুর। প্রথম কারণ, খবরের কাগজ সকাল সাতটায় ঘরে এলেও, তার হাতে প্রায় দশটা নাগাদ আসে। আর দ্বিতীয় কারণ, যদিও সেটাই আসল কারণ যে গত চার পাঁচ বছর তিনি সকাল বেলা কাগজ পড়ার কোন উৎসাহ বোধ করেন না। চোখের সামনে কাগজটা মেলে ধরলেই প্রতারণা, খুন, ধর্ষণ আর রাজনৈতিক নেতাদের চাপান উতোর ছাড়া আর কোন খবরই দেখতে পান না। আজকে কি মনে করে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায় মহীধরবাবুর। কাগজে বিরাট করে ছাপা হয়েছে, গতকাল বাস-অ্যাক্সিডেন্টে এক ব্যাক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একদল লোক পাঁচ ছটি সরকারি বাস, পুলিশের একটি জিপ, স্থানীয় পার্কিং প্লেসে রাখা বেশ কয়েকটি বাইক এবং কয়েকটি দোকানও ভাঙচুর চালায় এবং আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় সব কিছু।
    এই পর্যন্ত পড়েই বিরক্তিতে কাগজ ঠেলে সরিয়ে দেন মহীধরবাবু। তিক্ততায় ভরে যায় তাঁর মন। একটা মৃত্যু সবসময়ই অত্যন্ত দুঃখজনক। কোন কিছু দিয়েই, কোন ভাবেই সেই মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয়! একটা প্রাণ পৃথিবী থেকে চলে যায় আর যে পরিবারের সদস্য চলে যায় তার স্থায়ী ক্ষতি আর অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেই পরিবারেই। এটা তিনি ভীষণ ভাবে অনুভব করেন এবং যেকোন মৃত্যুই খুব কষ্ট দেয় তাঁকে। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কথাটাও ভীষণভাবে মনে হয় যে এই যে প্রতিবাদ, আন্দোলনের নামে সরকারি বাস, সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়া এগুলো কি সত্যি কোন সমাধানের রাস্তা দেখায় ? প্রথমত, যে সমস্ত সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সেগুলো তো আমাদেরই। আমাদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় কেনা, আর যে রাস্তা দিয়ে চলে এবং গাড়িগুলো চলার জন্য যে জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, সেটাও তো আমাদের টাকায় কেনা। অর্থাৎ সবটাই জনসাধারণের টাকা। ঘরের সামান্য কোন একটা জিনিস ভেঙে গেলে বা হারিয়ে গেলে কত আফসোস হয় আমাদের; তাহলে এক্ষেত্রে হয় না কেন ? আর এই প্রবণতা বড় ভয়ঙ্কর এই কারণে যে, ওইসব বাস ইত্যাদি জ্বালিয়ে দেওয়ার ফলে যে ভয়ঙ্কর গ্যাস উৎপন্ন হয় তা বাতাসে মিশে বাতাসকে ভারি ও দূষিত করে তোলে। ভয়ঙ্করভাবে দূষিত করে এই পৃথিবীর পরিবেশকে। একটি মাত্র মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাদের এই বিবেচনাহীন কাজ আরও অনেক মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এদের জন্য যেমন দৃষ্টান্তমূলক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত, তেমনি নিজেদের অজান্তেই সমাজের ও পরিবেশের কি মারাত্মক ক্ষতি তারা করে চলেছে, সে সম্পর্কে তাদের বোঝানোর জন্যও নিবিড় উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে সরকারি বেসরকারি সমস্ত স্তরে। একমাত্র তবেই বন্ধ হতে পারে এইরকম আত্মধ্বংসী কার্যকলাপ। মানবজাতীর এই রকম অজস্র আত্মধ্বংসী কার্যকলাপে একেবারে তিক্ত বিরক্ত হয়ে শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং বলেছিলেন মানুষের এইরকম চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপই পৃথিবীকে ক্রমশ জীবজগতের ভারবহনে অক্ষম করে তুলছে। অচিরেই সে বিদ্রোহ করবে এবং বিপন্ন হবে সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্ব।
    আর একটা ব্যাপারও খবরের কাগজের প্রতি তাঁর অনীহা বাড়িয়ে দিয়েছে, তা হল পাতা জোড়া বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন, যা বেশ ফলাও করে ছাপা হয় এবং বোঝাই যায় রীতিমত অর্থব্যয় হয় সেই বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি ও প্রকাশ করতে। তেমনই কিছু বিজ্ঞাপন মহীধরবাবুকে ভাবায়, বিচলিত করে। আজকের এই চরম ভোগবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র কোটি কোটি টাকা রোজগারের জন্যই এই বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি। তাই মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য নানা লোভনীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপনী সম্ভারে সাজানো হয় এই বিজ্ঞাপনগুলোকে। নিজের অজান্তেই কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন এই মিষ্টিমধুর রঙিন ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। নরম পানীয় থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রসাধনী দ্রব্য, সবকিছু রয়েছে এর মধ্যে। যেন ঐ বিশেষ জিনিসটা হাতে না পেলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এভাবে কোন কৃত্রিম উপায়ে নিজের স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য-বৃদ্ধি ও বজায় কোনটাই রাখা যায় না। এর একমাত্র উপায় হল এই পৃথিবীর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা। মনের ভেতরে তার আসন পাতা; একবার চোখ আর মন যদি এই পৃথিবীর সৌন্দর্য উপলব্ধি করার নেশায় মজে যায়, তাহলে এই পৃথিবীর অন্য কোন নেশা যেমন মদ্যপান, ধূমপান বা অতি মহার্ঘ কোন নেশাই চরম হার স্বীকার করে মুখ লুকোবার জায়গা পাবে না। কারণ অন্য সব নেশাই চরম ক্ষতি করে শুধু যে নেশাগ্রস্ত তারই নয়, তার আশেপাশে তার পরিবারের মানুষ,আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এমনকি সমাজের অন্য মানুষরেও। নষ্ট হয় তার সৌন্দর্য, দ্রুত কমে আসতে থাকে এই ধরিত্রী মায়ের অপূর্ব সৌন্দর্য ও অপরিসীম ভালোবাসা উপভোগ করার মেয়াদ। তাই নিজেকে, নিজের পরিবার ও চারপাশের মানুষকে একটা সুস্থ,সুন্দর ও দীর্ঘজীবন পাওয়ায় সাহায্য করতে চাইলে একমাত্র উপায় এই পৃথিবীর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা। এই পৃথিবীর সৌন্দর্য মানুষ যখন উপলব্ধি করতে পারবে, তখন সে নিজেই খুঁজে নেবে নিজেকে ভালো রাখার ও সুন্দর রাখার সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায়।
    ধরিত্রী মা বিশ্বজুড়ে যে প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদন করেছেন সারা বছরের জন্য, তা সে জল হোক বা বিশুদ্ধ বায়ু বা চাষযোগ্য মাটি, তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদনে আরও জোর না দিয়ে দেদার বনভূমি ধ্বংস করা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং সহ এল-নিনোর প্রভাব। ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। চরম বিপদ ঘনিয়ে আসছে অতি দ্রুত। এর একমাত্র প্রতিকার পরম যত্নে পৃথিবীর সম্পদ আগলে রাখা, প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদনের কর্মসূচি নেওয়া সর্বাগ্রে। দূষণমুক্ত নির্মল পৃথিবী যাতে বজায় থাকে তা সুনিশ্চিত করা। এর জন্যে প্রয়োজন এই পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা। তার যন্ত্রণাকে অনুভব করা। তবেই পৃথিবী বাঁচানোর জন্যে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।