।। ত্রয়োদশ।।

    আজকে স্কুলে পৌঁছতে অনেকটা দেরিই হল মহীধরবাবুর। আসলে রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখেন তাঁরই দুই ছাত্র রবিন আর বিশ্বরূপ বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে যাচ্ছে। স্যারের সঙ্গে মুখোমুখি হতেই ওদের বাবা রমেন ঘোষ বলেন, ‘স্যার ওদের দুই ভাইকে আর স্কুলে পাঠাবো না ভাবছি। গতবারের বন্যায় ফসলের যা ক্ষতি হয়েছে তা আর বলার নয়। প্রচুর দেনা হয়ে গেছে। তাই ভাবছি এবার তিন বাপ ব্যাটায় মিলে যদি কিছুটা সামলাতে পারি।’ ওদের মাথায় হাত রেখে মহীধরবাবু বলেন, ‘কিন্তু ওরা এখন সবে ক্লাস ফাইভ আর সেভেনে পড়ছে - এখনই পড়া ছাড়িয়ে দেবেন?’
‘তা কি করব বলুন, ফসলের যা ক্ষতি-’ কথা শেষ করতে না দিয়ে মহীধরবাবু বলে ওঠেন, ‘বার বার যে ক্ষতির কথা বলছেন, এই ক্ষতির জন্যে আপনি নিজেও কি দায়ি নন ? খুব অবাক হয়ে রমেন বলেন, ‘আমি!’
    ‘হ্যাঁ, আপনি, আমি, আমরা সবাই, যখন অনাবৃষ্টিতে মাঠের ফসল জ্বলে পুড়ে যায়, যখন অতিবৃষ্টিতে বন্যার ফলে মাঠের ফসল মাঠেই পচে নষ্ট হয়ে যায়, তখন খালি একথা বলি - হে ভগবান কী পাপ করেছি, কেন এমন শাস্তি দিলে ? এসব কথার কথা। সত্যি যদি বুঝতাম কতবড় পাপ করেই চলেছি - তাহলে এসব বিপদ ঘটত না। নির্বিচারে বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে দেওয়ার ফলে শুধু এখানেই নয়, সারা পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে গেছে বিপজ্জনকভাবে। তারপর আছে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষামূলক ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো। এর প্রভাব যে কী মারাত্মক তা এককথায় বলে বোঝানো যাবে না। এরপর আসি বন্যার কথায়। সময়মাফিক নদীর পলিমাটি না তোলার ফলে নদীর নাব্যতা অর্থাৎ গভীরতা একদম কমে যাচ্ছে। তার ফলে একটু বৃষ্টি হলেই ভেসে যাচ্ছে নদী। রাস্তাঘাট, পুকুর, মাঠ, চাষের জমি সব বন্যায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। তারপর, আমরা রান্না করার জন্যে যা যা ব্যবহার করি জ্বালানি হিসেবে, আমরা কখনোই তা ভেবে দেখিনা সেগুলো কি মারাত্মক ক্ষতি করে। ঘুঁটে, শুকনো পাতা,কয়লা, শুকনো কাঠ - এই সমস্ত উপকরণ দিয়ে উনুনে আঁচ দেওয়ার ফলে দীর্ঘসময় ধরে আশেপাশের অঞ্চল বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে উঠছে। এই বিষাক্ত ধোঁয়া দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে সরাসরি ক্ষতি করে চলেছে মানুষের আর বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিষাক্ত বায়ুস্তর ক্ষতি করে চলেছে প্রাকৃতিক পরিবেশের। প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমরা নিজেদেরকেই যে চরম বিপদে ফেলছি আর তার জন্য দায়ী যে আমরাই, সেটা এবার বোঝবার সময় এসে গেছে। তাই আসুন, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের ভুল, না ভুল নয়, অন্যায়কে শুধরে নিই তাহলে এই যন্ত্রণা, কষ্ট পেতে হবে না। আর হ্যাঁ, কাল থেকে ওদের স্কুলে পাঠাবেন। সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা আর সচেতনতা। ওরা সচেতন হলেই ঠিক আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে আপনাকে সাহায্য করার জন্য। বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য।’
    এই বলে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে হাঁটা দেন মহীধরবাবু। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মহীধরবাবু দেখেন, দুজনের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছে। একজন আর একজনকে ক্ষোভের সাথে বলছে- ‘তুই আমার এত বড় উপকারটা ভুলে গেলি? আজ যখন আমার এত দরকার, তখন তোর আর পাত্তাই নেই।’ অপরজন প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে এতে সত্যি তার কোন দোষ নেই। সে একটা সমস্যার মধ্যে আছে, কিন্তু অন্যজন তা বুঝতে নারাজ। দু’জন মধ্যবয়সী লোকের তর্কবিতর্কের মধ্যেই পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসেন মহীধরবাবু। ঠোঁটে মুচকি হাসি।
    একজন মানুষ হয়তো আরেকটি মানুষকে তার প্রয়োজনে সাহায্য করেছে বলে, প্রতিদান আদায়ের জন্য কি সাংঘাতিক জবরদস্তি! তাহলে এই পৃথিবী যদি প্রতি মুহূর্তে তার প্রতিদান এর তালিকা নিয়ে হাজির হয়, মানুষকে তো তাহলে পৃথিবী ছেড়েই পালাতে হবে। আর পালিয়েই বা যাবে কোথায় ? কে আশ্রয় দেবে ? কয়েকদিন আগে মধুক্ষরা তার মোবাইলে রাখা একটা ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখুন মহীদা, একটা ওরাংওটাং কেমন একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’ মহীধরবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘পূর্বপুরুষ তার উত্তর পুরুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু উত্তর পুরুষের কাছে এর কোন উত্তর নেই।’ অবাক মধুক্ষরা বলেন, ‘এর মানেটা বুঝিয়ে বলুন।’ হেসে মহীধরবাবু বলেছিলেন, ‘‘মনুষ্যত্বের প্রাণী, সে মানুষকে বাঁচাচ্ছে আর মানুষ মানুষকে ধ্বংস করে এই মানব সভ্যতাকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে কিভাবে একে অপরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। অথচ ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেই একসাথে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ হয়ে যাবে। তখন হাত বাড়ালে শুধু বন্ধু নয় তৈরি হবে এক অটুট বন্ধন। সে বন্ধনে এসে ধরা দেবে স্বয়ং এই পৃথিবী, তার সবটুকু অনুচ্চারিত ভালোবাসা নিয়ে আর মানুষের উত্তরণ ঘটবে ভালোবাসার এক নতুন পৃথিবীতে। সার্থক হবে ‘পৃথিবীবাসী’ কথাটা।’
    মহীধরবাবুর কথা শুনে মধুক্ষরা অপলকে তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে। একজন পৃথিবীবাসীর দিকে বা হয়তো একজন বিশেষ চোখে দেখা পৃথিবীবাসীর দিকে।