ব্যস্ত হয়ে একটা জরুরী কাগজ খুঁজে চলেছেন মহীধরবাবু অনেকক্ষণ ধরে। আসলে তিনি স্থির করেছেন যে স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দেবেন। সম্বিতবাবুর কাছে তিনি এই বিষয়ে চিঠিও জমা দিয়েছেন। তাঁর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা এবার তাকে শেষ করতেই হবে। সেটা হল স্ট্যাচু অফ মাদার আর্থ বা ধরিত্রী মায়ের মূর্তি তৈরী। এই বিষয়ে অনেকটা কাজ এগিয়ে গেছে কিন্তু আরও সময় চাই, পরিপূর্ণ ভাবে মনোনিবেশ করতে হবে এই কঠিনতম কাজে। তাই এই সিদ্ধান্ত। সেই চিঠিটার কপি খুঁজে চলেছেন তিনি।
এই সময়ে ঘরে ঢোকেন ধরিত্রী। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন মহীধরবাবুকে, তারপর খুব শান্ত গম্ভীর গলায় বলেন, ‘খুব ব্যস্ত না কি ?’
আচমকা ধরিত্রীর গলা শুনে চমকে ওঠেন মহীধরবাবু, একবার তাকিয়ে আবার খোঁজায় মন দেন। ফের বলে ওঠেন ধরিত্রী, ‘আমার কথা কানে গেল না? কিসের এত ব্যস্ততা তোমার, কি খুঁজছ তুমি?’ এইবার ঘুরে দাঁড়ান মহীধরবাবু। বোঝেন কিছু একটা কঠিন বোঝাপড়ার উদ্দেশ্যেই এই ঘরে এসেছে ধরিত্রী। সেই বোঝাপড়া শেষ করেই সে এ ঘর থেকে বেরোবে। তাই হাল ছাড়া গলায় বলেন, ‘না ব্যস্ত নই। কিসের ব্যস্ততা? আরে আমরা সবসময় বলে যাচ্ছি যে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু এটা আমি কিছুতেই বলতে পারি না কারণ যে কাজই করিনা কেন, আর তা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন আমি যদি এই পৃথিবীতে আসার সুযোগই না পেতাম অথবা এই পৃথিবীর যদি অস্তিত্বই না থাকে, তাহলে কোথায় থাকবে আমাদের এই ব্যস্ততার বুলি।’
‘চুপ, একদম চুপ।’ তীব্র গলায় ধমকে ওঠেন ধরিত্রী, ‘এইসব বড় বড় কথা একদম বলবে না আমার সামনে। পৃথিবী, পৃথিবী, আমি পৃথিবীকে ভালবাসি – ডাহা মিথ্যে, সব মিথ্যে কথা তোমার। যে নিজেকে ভালোবাসে না ,নিজের পরিবারকে ভালবাসে না, সে ভালবাসবে পৃথিবীকে;’ একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ান মহীধরবাবুর, আচমকা তার বুকের কাছে জামা খামচে ধরে বলেন, ‘কেন এ কাজ করলে তুমি ? এইভাবে বিট্রে করতে পারলে তুমি আমায়?’
‘বিট্রে! এসব কি বলছ তুমি?’ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে মহীধরবাবু।
‘কী বলছি বুঝতে পারছ না? পাশের ঘরে যে লোকটা থাকে তার সাথেই এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা ? পৃথিবীকে ভালোবাসার কথা বলো না তুমি, তাকে সুস্থ, সুন্দর রাখার কথা বলো না, দেখবে এই পৃথিবীও তোমার সাথে ঠিক একইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।’
‘না ধরিত্রী,’ গম্ভীর গলায় বলেন, মহীধরবাবু, ‘ভুল হচ্ছে তোমার। পৃথিবী বলতে আমি শুধু মানুষকে বুঝিনা। পৃথিবী বলতে আমি বুঝি কোটি কোটি জীবের জন্মভূমি ও বাসভূমি, পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রে ঘেরা এই বসুন্ধরা অর্থাৎ এই বিশ্ব মাকে আর এই বিশ্ব মায়ের সাথে আমাদের শুধু নেওয়ারই সম্পর্ক, না চাইতে সে আমাদের দু’হাত ভরে দিয়েছে কিন্তু আমরা তাকে বুঝিনা বা বুঝতেই চাইনা; তাকেই প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছি, তবুও সে কখনো, কোনো দিন বিশ্বাসঘাতকতা করে না আমাদের সাথে।’ একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আর এই যে পৃথিবী, যেখানে আমরা বসবাস করি সেখানে আমরা মানুষরা বা অন্যান্য জীব নয়, সব থেকে শক্তিশালী হল পৃথিবী। সে চাইলেই কিন্তু যখন তখন আমাদের ধ্বংস করে দিতে পারে। এবারে আমার নিজের কথা; নিজেকে খুব ভালোবাসি বলেই আমি পৃথিবীকে ভালবাসার, তার যত্ন নেওয়ার কথা ভাবতে পেরেছি। এই বিশ্বসংসারের সব কিছুতেই ভালবাসা আর প্রীতির ছাপ। পৃথিবী আমাদের ভালবাসতে শেখায়। কারোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা তাকে ধ্বংস করতে নয়। তাই বিশ্বাসঘাতকতা বা বিট্রে কথাটা বইতে পড়েছি কিন্তু তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তাই নাকি ? এটা তাহলে কি ?’ একটা চিঠি মহীধরবাবুর চোখের সামনে ধরেন ধরিত্রী।
‘এটা তো, এটা তো –’
‘যাক, চিনতে পেরেছ তাহলে - এটা হল তোমার চাকরি ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে লেখা চিঠি। এটাই তোমার ইচ্ছে?’
‘কিন্তু এটা তোমার কাছে ?’ বিষ্মিত মহীধরবাবু বলেন।
‘কি করে এল তাই তো ? আসলে সবাই এখনও তোমার মত বিশ্বাস ঘাতক হয়ে যায় নি; তাই সম্বিতবাবু স্কুল কমিটির কাছে এটা না পাঠিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলে গেছেন তোমাকে আরও একবার ভাবতে।’
‘কিন্তু আমার তো ভাবা হয়ে গেছে।’ শান্ত গলায় বলেন মহীধরবাবু।
ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় ধরিত্রীর, চীৎকার করে ওঠেন, ‘কি করে তোমার একার ভাবনা হতে পারে এটা? বিয়ের সময় তুমি শপথ করেছিলে না যে আজ থেকে আজীবন আমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তোমার ?’
‘সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। আমার পাওনা যা আছে স্কুল থেকে, সব তোমার নামে করে দিয়েছি। এমন কী আমার পেনশনও তুলবে তুমি। এই বাড়ি তোমারই। সুতরাং তোমার কোনো অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।’
‘ওঃ এত কিছু ভেবে রেখেছ। দয়া করছো তুমি আমাকে। তা হবে না-তোমাকে কিছুতেই জিততে দেব না। শেষ হাসি হাসতে দেব না আমি। রাগে ফুঁসতে থাকা ধরিত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন। বলেন, ‘আবারও তুমি একটা ভুল কথা বললে ধরিত্রী। অবশ্য এরকম ভুল কথা আমরা বলেই থাকি। এটা নতুন কিছু নয়। তবে একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে যে, এই শেষ হাসি হাসার অধিকার শুধু তুমি আমি কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষেরই নেই; আছে শুধু পৃথিবীর। আমরা এই পৃথিবী মায়ের বুকেই জন্মাই। তাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হয় আর মৃত্যুর পরও তার বুকেই আশ্রয় নিতে হয়। মাঝ জীবনের সময়টুকুতে আমাদের কখনো সুখ-দুঃখ, কখনো হাসি-কান্নার মধ্যে দিয়ে কাটে; কিন্তু যেদিন পৃথিবীর বুকে প্রথম এসে ছিলাম, সেদিনও সে যেমন হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল, ঠিক তেমনিই যাওয়ার দিনেও সে সস্নেহে বুকে টেনে নেয়। মাঝের সময়টুকুতে আমরা যতই তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাই না কেন, সে কিন্তু সবসময় একজন প্রকৃত মায়ের ভূমিকাই পালন করে। কাজেই তুমি আমাকে যতই শাসাও যে কিছুতেই আমাকে শেষ হাসি হাসতে দেবে না, তোমার এই শাসানির আসলে কোনো মূল্যই নেই। কারণ শেষ হাসি হাসার অধিকার একমাত্র আছে আমাদের পৃথিবী মায়েরই। আর কারোর নয়।’
মহীধরবাবুর শান্ত দৃঢ় কণ্ঠস্বরে একটু থমকে যান ধরিত্রী, বলেন, ‘তারপর? তুমি কি করবে ?’
একটু হেসে মহীধরবাবু বলেন, ‘আমার একটা কাজ বাকি আছে, জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তারপর কথা শেষ না করে চেয়ারে গিয়ে বসেন। আর কোনো কথা না বলে তাঁর ডায়েরি টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ধরিত্রী মহীধরবাবুর দিকে তাকিয়ে।