একটু অন্যমনস্কভাবে ক্লাস এইটের রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মহীধরবাবু৷ ক্লাসে বেশ হৈ চৈ, হাততালি আর হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ এই আনন্দ আর প্রাণোচ্ছলতা বেশ লাগে মহীধরবাবুর৷ দু’টো ক্লাসের মাঝের এই সময়টায় ছেলেমেয়েগুলো একেবারে নিজেদের মতো খানিকটা মুহূর্ত তৈরী করে নেয়৷ বড়ো ক্ষণস্থায়ী কিন্তু অত্যন্ত সজীব সেই মুহূর্তগুলো৷ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এইগুলো ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ অনুভব করেন আচম্কা হৈ-হুল্লোড় থেমে গেছে৷ তাকিয়ে দেখেন, তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা ওরা খেয়াল করেছে, আর তাই তাড়াহুড়ো করে যে যার জায়গায় বসে পড়েছে৷ ক্লাসে ঢুকে রোল কল করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি ব্যাপার, এত হৈ চৈ হচ্ছিল কেন? এখন ক্লাসরুম একেবারে নিস্তব্ধ৷ আরে কি হোল?’
এবারে রক্তিম উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘স্যার দেখুন না, ওরা সবসময় কঞ্চি কঞ্চি বলে রাগায়।’ মহীধরবাবু ওকে ভালো করে দেখেন, ক্লাস ফাইভ থেকেই দেখছেন রক্তিমকে৷ পড়াশোনাতে বেশ ভালোই, নানা বিষয়ে বেশ আগ্রহ আছে, ছেলেটা ভীষন রোগা। প্রথম-প্রথম মহীধরবাবু ভাবতেন, ঠিকমত সময়ে খায় না, কথা শোনে না, দুষ্টুমি করে, হয়তো এই কারণেই এতো রোগা৷ কিন্তু কয়েকবার ওর বাবা, কাকা এবং দাদুকে দেখেছেন, মহীধরবাবু৷ তারাও খুব রোগা৷
বুঝেছেন, এই ব্যাপারটা ওদের বংশগত৷ রক্তিমের চোখে মুখে অনেক অভিমান আর অভিযোগ রয়েছে দেখে একটু হাল্কা করার জন্যে মহীধরবাবু বলেন, ‘ভালোই তো, তোকে কঞ্চি বলেছে, তাই তুই এখন রাগ করছিস, কিন্তু তোকে যদি মোটা বাঁশ বলতো, তাহলে বড় হয়ে ওদের প্রতি আরও রাগ হতো, আর কোনোদিনই সেই রাগ তোর কমতো না৷ কারণ কঞ্চি যায় বেড়া বাঁধতে, সেটা আমরা প্রায় সবাই জানি, কিন্তু মোটা বাঁশ যে কখন কোথায় যায়, আর কি বিপত্তি ঘটায়, তার আগাম হদিশ আমাদের কারোর কাছেই থাকে না।’ ছেলেমেয়েরা হেসে ওঠায় তাদের হাত তুলে থামিয়ে মহীধরবাবু বলেন,
‘ঠিক আছে৷ এবার হাসাহাসিটা কি নিয়ে হচ্ছিল শুনি?’ রিক্তা বলে, ‘স্যার, ওকে আমরা রাগাই বলে ও আজ দুটো জামা পরেছে এই গরমে৷ তাই আমরা ওর জামা টেনে…’ কথা শেষ করতে না দিয়ে পল্লব চিমটি কাটে আর সঙ্গে সঙ্গে রিক্তা থেমে যায়৷ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব জোর হাসি পেয়ে গেছিল মহীধরবাবুর কিন্তু সামলে নিয়ে বলেন, ‘উঁহু, এটা কিন্তু ঠিক নয়৷’
‘স্যার আমরা তো ওকে সবসময় বেশি করে খেতে বলি, যাতে মোটা হয়৷’ ‘ও, তোদের ধারনা বেশি করে খেলেই কি মোটা হয়ে যায়?’ প্রশ্নটা রঞ্জনকে করেন মহীধরবাবু৷
রঞ্জন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে?!’ ‘আরে বোকা, সবার আগে দরকার মনের শুদ্ধি, মনের পুষ্টি আর মনের তুষ্টি৷ সুষম খাবার, প্রচুর ভিটামিন, ক্যালসিয়াম আর প্রোটিনযুক্ত খাবার খেলেই যদি স্বাস্থ্য একেবারে দারুন থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের ঐ ধরনের খাবার খাওয়ার ক্ষমতা আছে, তাদের তো কোনোদিনই স্বাস্থ্যও খারাপ হতো না, রোগে আক্রান্ত হয়ে ওষুধ, ডাক্তার, হাসপাতাল যেতে হতো না।’ একটু থেমে ছেলেমেয়েদের মুখগুলো একবার দেখে নিয়ে বলেন, ‘আসল কথা হলো সুষম আহার দরকার মনের, সেটা হলো মনের শুদ্ধতা, পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা৷ একবার ভেবে দেখ, পৃথিবী কোটি কোটি বছর ধরে আমাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে, কই তার প্রকৃতিতে, গাছের পাতার সবুজে, ফুলের গন্ধের রসে, ঝর্ণার জলে, প্রজাপতির ডানায় রঙের সুষমায়, কই কখনো তো এইসব জিনিস শ্রীহীন হয়না৷ আসলে এই পৃথিবী সর্বস্ব দিয়েও পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল, ঝলমলে৷ কারণ এই পৃথিবী আমাদের অপরিসীম ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়৷ তাই আমাদের মনে যে ভালোবাসার সঞ্চার হয়, তা কখনোই যোগ আসন বা প্রণায়াম বা মেডিটেশন বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে কাটিয়ে শক্তি সঞ্চয় যা হয়, সেটা হয় শরীরের, মনের নয়, মনের শক্তি আসে পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসায়, চারপাশকে সুস্থ, সুন্দর, নির্মল, দূষণমুক্ত রাখার প্রবণতায়৷ তাতে যতটুকু যা পাওয়া যায়, তাতেই শরীরের সুস্থতা বজায় তাকে৷ বোঝা গেল?’
‘হ্যাঁ স্যার, বুঝেছি।’
‘বেশ, তাহলে আজ থেকে তোরা কেউ রক্তিমকে কঞ্চি, কঞ্চি বলে খ্যাপাবি না, আর তোরও দুটো সার্ট পরে আসা চলবে না।’