।। পঞ্চবিংশ।।

    অনেকক্ষণ উসখুস করতে করতে বিছানায় উঠে বসলেন মহীধরবাবু। টর্চ জ্বেলে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত দেড়টা বাজে। মাথাটা ভীষণ ভারি লাগছে। বুকের উপর কেউ যেন একটা ভারি লোহার বল রেখে দিয়েছে। ঘরের বাতাসটা বড় কম কম লাগছে। বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো পায়ে দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।

    ঝকঝকে কালো আকাশ আর চকচকে তারারা দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে মহীধরবাবুকে। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালেন ঝাঁকড়া কদম গাছটার তলায়। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে কদম ফুলের গন্ধ এলো নাকে, সেই ছোটবেলার মত। শুনতে পেলেন সেই অমোঘ গাঢ় স্বর - কেমন আছো ? হাত রাখলেন গাছের গায়ে। হাতের তালুতে স্পষ্ট অনুভব করলেন গাছের ধুকপুকুনি। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আবার ফিরে চললেন নিজের ঘরের দিকে।
    ধরিত্রীর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়ালেন। খুব ইচ্ছে হল ঘরে ঢুকে একবার ধরিত্রীর ঘুমন্ত মুখটা দেখার। একবার ঘুমন্ত ধরিত্রীর মাথায় হাত রাখার। দরজায় ঠেলা দিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলেন মহীধরবাবু। কারণ মনের দরজা আর ঘরের দরজা, দুটোই ধরিত্রী অনেক দিন আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন। মন্ত্র পড়ে সহধর্মিনী হয়েছেন ধরিত্রী, কিন্তু সমধর্মিনী হয়ে উঠতে পরেননি কোনদিনই। হয়তো চাননি।
    ঘরে এসে চেয়ারে বসলেন মহীধরবাবু। কাল সকাল থেকেই অনেক কাজ। কাল পৃথিবীর জন্মদিন পালিত হবে। ধরিত্রী মায়ের যে মূর্তি অনেক দিনের সাধনায় আর পরিশ্রমে তিনি তৈরী করছেন তার গায়ে বড়ো যত্নে আর ভালবাসায় হাত বোলালেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবে কাল। কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে আজ। পৃথিবীর জন্মদিন পালন নিয়ে কত লোক কত ব্যঙ্গ করেছে। কেউ বলেছে- নিজের জন্মদিনই খেয়াল রাখার ফুরসত নেই তো পৃথিবীর জন্মদিন; আবার কেউ অবাক হওয়ার ভান করে বলেছে- পৃথিবীর জন্মদিন পালন করবেন! তা কই পৃথিবী কবে জন্মাল, টের পেলাম না তো! তাদেরকে তিনি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন, মানুষ তার নিজের জন্মদিন হিসাব ধরে সেই দিনটাকে, যেদিন সে মাতৃগর্ভের আড়াল সরিয়ে আশ্রয় নেয় ধরিত্রীর বুকে। কিন্তু সেই দিনটা তো তার জন্মদিন নয়। ভ্রূণ হয়ে মাতৃজঠরে অবস্থানের প্রথম দিনটিই প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষের জন্মদিন। কিন্তু একজন মা সেই ভ্রুণস্থ সন্তানের অস্তিত্ব টের পান কিছুদিন পরে। তাই একটি মানব শিশুর একেবারে একশো শতাংশ নির্ভুল জন্মক্ষণটি জানেন একমাত্র বিশ্বসৃষ্টি কর্তা। যিনি আক্ষরিক অর্থেই সর্বজীবের জন্মদাতা। তাই যদি একজন মা সন্তানের জন্মের অস্তিত্ব টের পান, তার জন্মের কিছুদিন পরে তাহলে কোটি কোটি বছর আগে বিশ্ব সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছেতে তৈরী এই পৃথিবীর জন্মদিনটি জানা কি আদৌ সম্ভব! তাই আমরা নিজেরাই একটি দিন ঠিক করে অন্তরের কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা, নাচে, গানে, কবিতায় বরণ করে নিতে পারি তাকে, রঙ্গিন করে তুলতে পারি এই দিনটিকে। নানা ব্যঞ্জনায় চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারি এই দিনটাকে। কাল সেই দিন। কিন্তু চোখের পাতা দুটো এত ভারী হয়ে উঠছে কেন - ঘরের আলোটা এত কম লাগছে কেন - কে ডাকলো ? - স্বপন বাউল, না না এত রাতে স্বপন কোথা থেকে আসবে – তবে কি সম্বিত বাবু ? উনি বড্ড ভালোবাসেন আর চিন্তা করেন। কয়েকদিন আগে তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে হাসিমুখেই জানতে চেয়েছিলেন, ‘কেন এই পৃথিবী নিজেই সর্বোত্তম সাবজেক্ট সেই ব্যাখ্যাটা আপনিই দিন’। মহীধরবাবুও হাসিমুখেই শুরু করেন, ‘দেখুন, সর্ববিষয় দাঁড়িয়ে আছে সৃষ্টির উপর, কোন সাবজেক্ট শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে তর্ক, এক একটি বিষয়ে জুড়ে সারা পৃথিবী জুড়ে নানা মতবাদ ও তাই নিয়ে তুমুল আলোড়ন, সেই পৃথিবীই তো “Subject of all subjects, greater than the greatest.” আপনিই বলুন না, সব সাবজেক্ট এর সাথে সব সাবজেক্ট এর তুলনামূলক আলোচনা হয়, কিন্তু পৃথিবীর সাথে কারোর তুলনা হয় কি ? সর্ব বিষয়ের আকর সে। নিজেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সাবজেক্ট। তাঁর কোন ব্যাখ্যাকারের প্রয়োজনই নেই।
    “She is one and only one unwritten subject which adopts
every subject and presents the finest extracts from within, for the citizen of the Earth –” কোনো চিন্তা করবেন না - সব আয়োজন করা হয়ে গেছে - ঐ যে সব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা, ওরাই দায়িত্ব নিয়ে করেছে সব - বড্ড কষ্ট হচ্ছে - বড়ো হাঁ করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলেন মহীধরবাবু। মাথাটা ঝুঁকে পড়লো টেবিলের উপর। ধরিত্রী মায়ের মূর্তির পায়ের কাছে - একবার অস্ফুট উচ্চারণ করলেন- ধ-রি-ত্রী।
    শেষ মুহূর্তে কাকে স্মরণ করলেন মহীধর। বিশ্বমাতা ধরিত্রী নাকি তার স্ত্রী ধরিত্রী - না কী একসাথে দু’জনকেই; এই প্রশ্নের উত্তর অজানা, অনুচ্চারিতই রয়ে গেলো এই ধরিত্রীর বুকে।