যে কথাটা আমি বলতে ভুলে গেছি, সেটা এখানেই বলে শুরু করব পরের অধ্যায়৷
সেটা হল, আমি ১৯৯৮ সালে আমার গ্রামের বাড়িতে লাগিয়েছিলাম এক হাজার গাছ৷ ওদেরকে আমি দেখতাম! নিজের মতো করে দেখতাম৷ গাছের প্রতি এতো ভালোবাসা কেন জানতাম না৷ আজও জানি না৷
শুনেছিলাম, বিজ্ঞাসী জে-সি বোস, মানে জগদীশচন্দ্র বসু, যিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় তিরিশ বছর গবেষণা করে---যেটা দিয়ে দেখানো হতো গাছেরও প্রাণ আছে, সেই যন্ত্রে প্রমাণিত হয়েছে গাছ কী করে বাড়ে ও নানারকম অবস্থাতে কী করে স্পন্দিত বা কম্পিত হয়৷
সব-ই মানুষের মতো৷
একদিন তিনি রাত্রে বাড়ি ফিরছেন, হঠাৎ তাঁর মনে হল, বাগানটা ঘুরে আসি৷ আমরা তো রাত্রে গাছের মধ্যে প্রবেশ করিনা৷ নানা কারণে৷ কিন্তু তিনি একদিন বাগানে প্রবেশ করলেন রাত্রে বাড়ি ফেরা মাত্র-ই৷
হঠাৎ একটি গাছ তার ডালকে জগদীশচন্দ্রের গায়ে লুটিয়ে দিয়ে আবার তুলে নিল৷
‘কী ব্যাপার!’, জগদীশচন্দ্রের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, কী করে এমনটা হয়! ওই সময় ঝড় ছিল না, ছিলনা হঠাৎ কোনো বাতাস, একদম শুনশান৷ গাছে কোনো হনুমানও নেই! কী করে হয়!
তিনি তখন নিজের মতো কিছু ভাবলেন! গাছের ডালটি কেন লুটিয়ে পড়ল গায়ে!
অন্য গাছগুলি তো এমন করে নি!
তিনি এবার একটু থমকে দাঁড়ালেন! তারপর সোজা চলে এলেন ঘরে, এসেই মালিকে জিগ্যেস করলেন যে সে বাগানে সব গাছে জল দিয়েছে কিনা!
মালি খানিকক্ষণ যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল৷ তারপর কী যেন ভেবে বলল, ‘বাবু, সারা বাগান জল দিয়ে শেষে একটা গাছে জল দিই নি, আসলে তখন জল শেষ হয়ে গেছে৷ আর পুকুরে নেমে জল নিয়ে আসিনি পরের দিন দেব বলে! কী হয়েছে বাবু!’
জগদীশচন্দ্র বললেন, ‘কোন গাছটা?’ এবার মালি কোন গাছটা বলে দিল৷
এবার তিনি বললেন, ‘ওই গাছটাই তাঁর ওপর কীভাবে একটা ডালকে হঠাৎ নামিয়ে দিয়ে তার প্রতিবাদ জানাল!’
শুনে মালির তো চক্ষু চড়ক গাছ৷
কাহিনিটা বলতে গিয়ে অনেকটা লেখা বেড়ে গেল৷ কারণ গাছই আমাদের সব কিছু৷ গাছ না থাকলে আমরা বাঁচিনা৷ তার জন্য এটুকু সময় আর শব্দ খরচ যদি না করি, সেটা কত বড় বেইমানি হবে৷ এই যে কাগজ, এটাও গাছ কেটে বানানো৷ গাছ থেকেই তো আমাদের সব পাওয়া৷ এই গাছের জন্য আমরা বইতে একটু জায়গা দেবনা তা কি হয়!
না, আর এই কথা বাড়াবো না৷ কিন্তু আমি বলছি যে, আমি যখন ওই ঘটনা পড়িনি, কিন্তু কী যেন এক অজানা নিয়মে আমিও গাছকে ভালোবাসতাম৷
আমি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র নই৷ আমি তুচ্ছ এক নাগরিক মাত্র৷ কিন্তু গাছকে আমি ভালোবাসতাম শৈশব থেকে৷
আমি ঐ গাছগুলি লাগিয়ে ভাবতাম---যেন কিছু একটা করতে পেরেছি৷ নিজের মতো নিজে ভাবছি৷
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন একটি কবিতায়---তিরিশ বছর কবিতা না লিখে যদি একটা গাছ লাগাতাম---এই জাতীয় একটা কথা৷
গাছের প্রতি কী এক মমত্ব ছিল কবির!
না, আমি বিজ্ঞানী বা কবি কেউ নই, একদম সাধারণ নাগরিক৷ জাহাজে বা ডাঙায় রেঁস্তোরায় হয়তো আমি উঁচু পদে চাকরি করেছি, দেশ দুনিয়া নিয়ে কিছু বুঝতে পারি, দু পাঁচটা বিদেশি ভাষা জানি, কর্মের নিয়মে শিখে ফেলেছি, মুখে খারাপ কথা আনতে চাই না, শ্রম করে বাঁচতে হয়---এই সত্যটা মানি, সৎ পথের কোনো বিকল্প নেই---এটাও মেনে চলার চেষ্টা করি৷ যদিও প্রচলিত সামাজিক কিছু ভুল অভ্যাসের কারণে আমার মধ্যেও কিছু ভুল প্রবণতা চলে আসে, সেটার জন্য পরে কষ্ট অনুভব করি৷ কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে, বিশ্বকে ভালোবাসার উপলব্ধি আমাকে একটু একটু করে স্বচ্ছ করছে৷
সে দিক থেকে আর পাঁচটা সাধারণ নাগরিকের কারোর কারো থেকে আমার গুরুত্বকে হয়তো একটু ভিন্ন মাত্রায় কেউ ভাবতে পারেন, কিন্তু আমি তো তথা-কথিত কোনো স্রষ্টা বা দার্শনিক নই৷
কোনো বড় ভাবনা আমার নেই৷ শুধু গাছ ভালোবাসি৷
আর সেই গোপন প্রেম এমন গভীর ছিল, ধরো আমি কয়েক বছর পর বিদেশ থেকে আমি বাড়ি ফিরছি, যত রাত্রেই হোক, বাড়িতে না ঢুকে---বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে টর্চ চেয়ে নিয়ে আমি প্রথম ঢুকবো আমার গাছগুলির সংসারে৷
ওরা কী খাচ্ছে, কেমন আছে, ওদের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর নিয়ে নিতাম আগে৷
ওরা ওদের ভালো-মন্দ আমাকে জানাত৷ বলত, ‘মাইকেল, তুমি এত দেরি করে আসো কেন! আমরা একা হয়েপড়ি, তুমি চলে গেলে৷’
এসব কথা যেন আমি শুনতে পেতাম৷
লোকে অনেক কিছু ভাবত৷ কারণ, বিদেশ থেকে একটা ছেলে এলে,---বাপ মা গুরুজনদের আগে প্রণাম করবে, ভাইবোনদের হাতে তুলে দেবে উপহার, এসব না করে সোজা গাছদের ভিতরে চলে যায়৷
গুরুজনরা ভাবতেন কিছু, আমি ওদের কথা শুনতাম না৷ আমি জানতাম, আমাদের সকলের প্রথম গুরুজন গাছ৷ ভাই-বোন,প্রেমিক-প্রেমিকা এই গাছ৷ এই বিশ্ব সংসার হল গাছেরই বিস্তৃতি৷
তাই ওদের আগে প্রণাম করে আসতাম৷ আমার বাবা মা দাদাদের প্রণাম করার আগে৷ ওদের উপহার তুলে দিতাম---সেই উপহার-এর নাম ‘‘আমার আগমন বার্তা’’৷
মিষ্টি-মিষ্টান্ন টাকা পয়সা---মানুষের মতো কোনো কিছু চায় না, মানুষের মতো শুধু নিয়ে নেব, --- সেটা ওদের নেই, ওরা শুধু খুশি আমার আগমন বার্তায়৷
আমি এই গাছ কাহিনি বললাম নিজেকে মহামানব সাজানোর জন্য নয়---মূলত ওদের কথা না বললে, আমি শান্তি পাব না তাই৷
ওরা আমার জীবন, ওরা পৃথিবীর জীবন, আর পৃথিবীর গুরুজন৷