নয়

এবার আসি এমন একটি বিষয়ে, যেটা আবার আর একটু অন্যরকম৷ আগের কোনো অধ্যায়ে এটাও একটু ছুঁয়ে গেছি৷ আচ্ছা, ভাবুন তো, আমরা পৃথিবীতে নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা করি বা এই নিয়ে জি-কে বা জেনারেল নলেজের বই আছে অনেক৷ আর সেই বই পড়লেই আমরা নাকি জ্ঞানী হয়ে উঠি৷ কোন দেশের নদী বড়, কে ক’বার কোন পুরস্কার পেলেন? কে ডাকাত থেকে মহাকবি হয়েছিলেন৷ এই রকম লাখ লাখ প্রশ্ন আছে ও আরো তৈরি হচ্ছে৷
কিন্তু যে-পৃথিবীমাতার ওপর আমরা জন্মাই ও বাস করি তাঁর ভালোবাসায়, তাঁকে নিয়ে কেউ প্রশ্নোত্তর করিনা৷
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল, বিশ্বমাতাকে নিয়ে কি কোনো প্রশ্নোত্তর করা যায় না৷
ষাট-সত্তরটি বানালাম নানা সময়ে এই প্রশ্নোত্তর, নামকরণ হোলো ‘নিউ থট‍্ ওল্ড আর্থ’---নতুন ভাবনা, পুরানো পৃথিবী৷
না, এই প্রশ্নগুলির সব-ই যে উন্নত মাপের ছিল তা নয়, কিন্তু কোনো সৃষ্টিই প্রথমে উন্নত স্তরের হয় না৷ সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনার নানা বিবর্তন হয়, সেই মতো কোনো সৃষ্টি তার রূপ ও ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়৷
এই যেমন ধরুন না, বিজ্ঞানী গ্যালভানি, যখন ব্যাঙের শরীরে ব্যাটারিতে লাগানো তার জুড়ে দিয়ে ব্যাঙ নাচাতেন, তখন তাঁকে লোকে অনেকটা হেয় করে বলত, ব্যাঙ নাচানো অধ্যাপক৷ সেই ব্যাঙ নাচানো অধ্যাপকের সেই কাজের ফল আজকের রেডিও, টিভি থেকে বৈদ্যুতিক সব রকমের ব্যবহার৷
আমি নিজেকে গ্যালভানির আসনে বসাতে চাই না, কারণ তাঁরা আমার কাছে মহাপুরুষ, আমি বলতে চাই, আমি আজ যা করছি তার প্রকরণ হবে আরো আরো উন্নততর, সব ক্ষেত্রেই এটা সত্য৷
তাই আজ আমি পৃথিবীকে নিয়ে যে সব প্রশ্ন তৈরি করেছি, তার ওজন কতটা সেটা প্রশ্ন নয়, আসল কথাটা হল, এই বিভাগেও অনেকে ভাববেন৷ জন্ম নেবে আরো আরো আকর্ষণীয় প্রশ্নগুলি কোনো একদিন৷ এই ভাবেই তো আমরা এগিয়ে যাই৷
খুবই সুখের খবর, এক নামী চিত্র পরিচালক আমার এই প্রশ্নগুলির ওপর ভিত্তি করে গ্রন্থ অনুলিখন করেছেন ও তিনি চিত্রনাট্য লিখেছেন ফিচার ফিল্ম বা কাহিনি চিত্র করবেন বলে৷ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা৷
এই সিনেমার কথা বইয়ের শেষের দিকে বলেছি৷ কিন্তু, এখানে বিষয়টা চলে এলো ঐ প্রশ্নোত্তরের কাহিনি বলতে গিয়ে৷
আশা করি বেশ ভালো লাগছে আপনাদের৷
হ্যাঁ, এবার একটা কথা বলি, তা হোলো, আমার ধারণা, বা ব্যক্তি উপলব্ধি--যাই বলুন, কর্ম করে যুক্তিগ্রাহ্য ভাবনাকে পাওয়া যায়, কর্ম না করে যুক্তিগ্রাহ্য ভাবনাকে পাওয়া কঠিন৷
এখানে আর একটু কথা জুড়ে দিই, এত কথা বলা হল--- যে কথা কয়টি হঠাৎ করে মনে হল, আমার মনে হয় এত ভাবনার ধারা যেন এক জায়গায় মিশে যেতে চায়৷ সেই পাঁচটি ভাবনা হলঃ-
আমরা সবাই দাবি করি আমি এই করেছি, আমি সেই করেছি৷ এটা ঠিকই যে কোনো কাজই কোনো না কোনো মানুষ করে৷ প্রচলিত নিয়মে এই ধরনের কথা বলতে হয়৷ সেটাই স্বাভাবিক৷ আর যখন কেউ বড় কাজ করেন, তখন সেটার জন্য তাঁকে আমরা ভালোবাসি বা শ্রদ্ধা করি৷ এই ধারা আমাদের প্রয়োজন৷ গুণীর প্রতি শ্রদ্ধা৷
কিন্তু আমরা এর গভীরে গিয়ে আরো যাকে শ্রদ্ধা জানানো দরকার, সেটা আমরা করিনা, সেটা করলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা দেখানোর বা কৃতজ্ঞতা দেখানোর কর্তব্যকে পরিপূর্ণতা দিতে পারব৷
এবার বিষয়টাকে খুলেই বলি৷
পৃথিবীতে যে যা কিছুই করুন সেটা পরোক্ষ, আর প্রত্যক্ষ হলো সবই দিচ্ছেন আমাদের পৃথিবী মাতা৷ কারণ, তিনি তো মানব রূপের দাতার-ও স্রষ্টা৷ আমি এর দ্বারা কোনো মহানকে কম মূল্য দিচ্ছি না, আর তা ছাড়া যাঁরা এই জগতের জন্য অনেক ত্যাগ করে যান, তাঁদের নিজেদের বিশ্বাসও এই যে, তাঁরা কিছুই নয়৷ কেবল ভালোর জন্য কিছু করতে তাঁদের ভালো লাগে৷ তাই আমি তাঁদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল৷
কিন্তু, আমরা যখন সেই মহানদের শ্রদ্ধা দিতে গিয়ে আগে পৃথিবীমাতাকে ভালোবাসা দেবো, তখনই আমাদের বিচার শক্তির পূর্ণতা আসে ও কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠি৷ তাই আমাদের মনেপ্রাণে সব সময় পৃথিবীমাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷
এবার আসি মানুষের একটা বিশেষ হাস্যকর চরিত্র নিয়ে৷ সে প্রতিদিন পৃথিবীতে কতো বেশিদিন বাঁচতে পারে তার জন্য চেষ্টা করে৷ অশিক্ষিত থেকে শিক্ষিত, গরিব থেকে ধনী, সকলেই৷ তাই সে সৎ বা অসৎ উপায়ে, যে ভাবেই হোক, অর্থ সম্পদ উপার্জনের পথ গ্রহণ করে৷ যাতে দীর্ঘায়ু হবার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা সে গ্রহণ করতে পারে৷ আবার মৃত্যুর সময় তার শেষ ইচ্ছা হল, যদি জন্মান্তর সত্য হয়, তবে পৃথিবীতে সে যেন পুনরায় ফিরে আসে মানুষের জন্ম নিয়ে৷ আর যদি অমরতা পাবার কোনো পথ আবিষ্কার হয়, তবে তো আর পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
এখানে আমার প্রশ্ন যে-পৃথিবীতে সে দীর্ঘদিন থাকতে চায়, অমরতা পাবার পথ থাকলে অমরতাও পেতে চায়, আবার মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসতে চায় এখানেই, এই পৃথিবীতে, সেই পৃথিবীর প্রতি তার দ্বায়িত্ব নেই? আত্মত্যাগ নেই?
আর সেই পৃথিবীকে যারা নানা ভাবে নষ্ট করছে, তাদের প্রতি সে নীরব থাকে৷ কোনো প্রতিবাদ নেই, পৃথিবীকে নষ্ট না হতে দেবার জন্য সে কোনো জনজাগরণ তৈরি করা তো দূরের কথা, নিজের বাড়ির কাউকেও সতর্ক করে না, অথচ পৃথিবীর প্রতি তার কতো টান! আমি বিস্মিত হয়ে যাই এই কথাগুলি ভাবতে ভাবতে৷
আপনারা বলুন, এই কথাগুলি কি আমি ভুল বলছি!
এবার তিন নম্বর বিসয়টা বলি, আমরা সমাজে দেখি, পরিবারগুলিতে অভিভাবকগণ যখন দৈহিক ভাবে রূপ লাবণ্য হারান ও ক্রমশ কর্ম ক্ষমতা হারান, তখন তাঁদের বংশধরেরা নানা রকম অপমান জনক ভাষায় সম্বোধন করে, কেউ বা বাবা-মা, বা এই ধরনের গুরুজনদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, কেউবা বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে বাবা মাকে পথে ফেলে দিয়ে যায়, আর যদি কোনো ভাবে ওই অগ্রজ বা অগ্রজগণ সংসারে বংশধরদের সাথে থেকে যান তবে তাঁদের অনেক গোপন পদ্ধতির অত্যাচার সহ্য করে থাকতে হয়৷ যাকে বলে নরক যন্ত্রণা৷ তাঁরা তখন কোনো ভাবে কাটিয়ে দেন, যত দিন এভাবে কাটে!
এই ছবি সাধারণত প্রায় সব পরিবারে, বিষয়টা একই রকম৷ হয় তো পরিবার অনুযায়ী রূপটা একটু অন্য ধরনের হয় একটা পরিবার থেকে আর একটা পরিবারের৷ কিন্তু ফলাফলটা এক৷
এই ফলাফলের চাকায় চলছে পৃথিবীটা যে আজকে শিশু, সে কাল বড় হচ্ছে, তার অগ্রজ বা অগ্রজদের থেকে সব নিয়ে পরে তাঁদেরকে সংসারের বোঝা ভাবছে, আবার সে যখন নিজে তার বাবা মা ঠাকুরদা ঠাকুরমায়ের মত ক্ষমতা ও শরীরের রূপলাবণ্য হারায়, তখন তাকেও তার অনুজদের থেকে একই ভাবে আচরণ পেতে হয়, যেভাবে সে তার অগ্রজদের ওপর করেছিল৷
এরফলে প্রতিটি পরিবারের ছবি সেই এক৷
আপনারা বলবেন, এর সুরাহা কী৷
আমার কথা হল, বাবা-মায়েরা সংসারে একটা সময় অবহেলা পেতে শুরু করেন, তার কারণ, তাঁরা ছেলে মেয়েদের শেখান না যে, পৃথিবীই সব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন, তাঁর প্রতি সকলের দায় ও ভালোবাসা থাকা দরকার৷
এটা না বলে, বাবা-মায়েরা শেখান যে, তাঁরা সব করেছেন, তাই তাঁদের জন্য তাঁদের ছেলে মেয়েদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ কিন্তু, সঠিক অর্থে কৃতজ্ঞতা ব্যাপারটা তো এমন ভাবে আসে না, প্রতিষ্ঠাও পেতে পারে না৷
এই যে পৃথিবীর প্রতি প্রতারণা, এর ফলে বংশধরদের বুদ্ধি বিবেচনার বিকাশ ঘটে না, কারণ, তারা বিবেচনার জন্য নিরপেক্ষ অনুভূতি লাভ করে না, ‘কৃতজ্ঞতা’ শব্দটা তো অনেক দূরে! বরং বড়দের থেকে ‘কৃতজ্ঞতা’ নিয়ে ভুল ব্যাখ্যায় মজে গিয়ে প্রথম জীবনে অনুজদের মনটা দিশা হারিয়ে ফেলতে থাকে, পরপর৷ তার ফল পরে ভয়াবহ হয়ে ওঠে৷ তাই বাবা মায়ের উচিত, সঠিক কথাটা স্বীকার করা৷
কেউ বলবেন বাবা-মা যা বলবেন তা ঠিক নাকি, তাঁদের অন্ধভাবে মেনে নেব কেন৷ ভুলকে কোনো ভাবেই যদি মেনে নেওয়া হয় তবে সেটা বিপন্নতা নিয়ে আসবে৷ এটা জীবনের সত্য৷ সেটা যে যাই বলুক না৷
আমি বলছি যে, ওটা আলাদা দিক৷ বাবা-মা যে যা বলবেন, তা সবসময় ঠিক, সেটা আমি বলি না৷
এগুলি আবার অন্য দিক৷ কিন্তু আমি বলতে চাই যে, এই কথাটাতো ভুল নয় যে, প্রকৃত যিনি সব কিছু দাত্রী তাঁর প্রতি দায় রাখাই সবচেয়ে বড় গুণ৷ আর একটা কথা, এই বিরাট সত্যকে যখন বাবা মা মেনে নেবেন, তখন সব সমস্যা চলে যাবে৷ কারণ, তখন বাবা মায়ের সঠিক চিন্তা ও ‘কৃতজ্ঞতা’ শব্দটা নিয়ে মহৎ ব্যাখ্যা ছেলে মেয়েদের প্রকৃত বিনীত ও সার্বিক ভাবে কৃতজ্ঞ করে তুলবে৷
এইসব কথা বলতে গিয়ে, এই প্রসঙ্গে অনেক অনেক ভাবনা মাথায় আসতে থাকে একে একে৷ সত্যি কথা বলতে কী, পৃথিবীটাই আসল জ্ঞানের ভান্ডার৷ এই জ্ঞানের ভান্ডারকে ভালোবাসতে বা উপলব্ধি করতে গেলে প্রথমে নিজের জন্মস্থানকে ভালোবাসতে হবে৷ আসলে সেই প্রকৃত ভালোবাসারই মানুষটিকে পৃথিবীটা কী, আমাদের কর্তব্যই বা কী, আর আমাদের দ্বায়িত্ববোধ কী হওয়া উচিত পৃথিবীর প্রতি, তা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে৷
এবার আসি শেষ ও অন্তিম ভাবনায়৷ যদিও পৃথিবীকে নিয়ে শেষ বা অন্তিম ভাবনা বলে কিছু হয় না৷ বিশেষ কয়েকটি কথা বলে শেষ করছি৷ পৃথিবীকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যা ভীষণ ভাবে নাড়া দেয় আমাকে৷ বিষয়টি হল, আমরা সবাই ধর্মীয় স্থানে যাই নিজের নিজের ঈশ্বরের উপাসনার জন্য৷ আমরা বিশ্বাস করি যে, এই ধর্মীয় স্থানগুলি খুব শক্তিশালী৷ কিন্তু কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ওই ধর্মীয় স্থানগুলি আমাদের বাড়ি-ঘরদোরের মতো নষ্ট হয়৷ এর মানে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বর তাঁর এই মহান বিরাট সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, তাঁকে নিয়ে কোনো খন্ড ভাবনার প্রবণতাকে তিনি সমীহ করেন না৷ আমি কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত হানছি না, আমি বরং এটাই বলতে চাইছি যে, ঈশ্বরকে যারা যে-রূপেই গ্রহণ করিনা কেন, পৃথিবীকে ভালোবাসলে, সকলের নিজস্ব নিয়মের মহান বিশ্বাসগুলির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে৷ তাই আসুন, তাঁকেই আমরা আঁকড়ে নিই, সবচেয়ে কাছের ব’লে৷
তাই সবদিক থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, পৃথিবীকে আমরা ভালোবাসলেই পরিবারের যে জ্বালা যন্ত্রণা উৎকন্ঠা এগুলি চলে যাবে ও সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজ লাভ করবে স্থায়ী সুস্থতা৷
এর নাম বিশ্বশান্তি৷ বলুন, আপনি কি এই যুক্তিগুলি অস্বীকার করতে পারেন?