।। চতুর্থ অধ্যায়।।

শরীরের রোগ ভালো করার জন্য সমাজে রয়েছেন ডাক্তাররা, মনের রোগ ভালো করার জন্য মানসিক রোগের ডাক্তার, রয়েছেন মনস্তত্ত্ববিদ। কিন্তু আত্মার রোগের চিকিৎসক কে আছেন এই পৃথিবীতে! আমি জানিনা, তবে এটা নিশ্চিতভাবেই জানি, এই মুহূর্তে আমার দিকে বিষ মাখানো তীরের মত ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত প্রশ্ন ছুটে আসবে! এত বড় বড় কথা- আত্মার রোগ! আরে ভাই আত্মার সম্পর্কে কি জানেন আপনি? আপনি আত্মার রোগের কথা বলছেন যে বড়! এত স্পর্ধা হলো কি করে? আমি হাত জোড় করে, মাথা নিচু করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সত্যি সত্যি আমি এই বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না, আর এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো পাণ্ডিত্য আমার একেবারেই নেই। অল্পস্বল্প যেটুকু পড়ে বা শুনে জেনেছি, তা হল আত্মা বায়বীয়। আত্মার কোন আকার নেই এবং গীতায় উল্লেখ আছে- আত্মার জন্ম, বৃদ্ধি, বিকাশ, বিনাশ বা মৃত্যু, এসব কিছু নেই। যতক্ষণ জীবন থাকে ততক্ষনই আত্মা ঐ শরীরে থাকে, শরীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মা ঐ শরীর পরিত্যাগ করে। এই সমস্ত জানার পরে নিজে নিজে চিন্তা করে আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি যে আত্মা এক শক্তির ঢেউ, যা বলেছে এই পৃথিবীর সর্বত্র। এই শক্তি ছাড়া সবকিছুই, সে কোন প্রাণীর শরীর হোক অথবা গাছ কিংবা ইট, কাঠ, পাথর- সবই শুধুমাত্র জড়পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। আচ্ছা, তাই যদি হয়, তাহলে ঐ যে একটা কথা আছে- মে হিজ/হার সোল রেস্ট ইন পিস। এই কথাটার তো সত্যি সত্যি কোন মানে হয় না, কারণ আত্মা কোথাও বদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না! ঠিক এইখানেই আমার বলা ঐ কথাটাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে; ঐ যে বলেছিলাম না- আত্মা রোগগ্রস্ত হলে তার চিকিৎসা কে করবে! আমারই ব্যাখ্যায় আত্মা যদি অফুরন্ত শক্তির ঢেউ হয়, এন্ এন্ডলেস ওয়েভ অফ্ পাওয়ার- তাহলে আত্মা রোগগ্রস্ত বা রোগমুক্ত- কোন অবস্থারই অধীন নয়। আত্মা শুদ্ধ, পরিপূর্ণ এক শক্তি। এই শক্তি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই আছে। 
আমার প্রশ্ন এইখানেই- এই শুদ্ধ ও পরিপূর্ণ শক্তি যদি সবার মধ্যেই বিদ্যমান থাকে, তাহলে জঘন্য সব অপরাধ আমরা করি কি করে? কেন প্রত্যেকদিন সকালে খবরের কাগজ খুললেই এক একটা বীভৎস সংবাদ আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়? আমরা অবাক হয়ে ভাবতে বসি এও সম্ভব! আসলে ঐ একই কথা। আত্মা শুদ্ধ ও পবিত্র। কিন্তু এটা শুধু বইয়ের পাতায় কালো কালো অক্ষরে আটকে থাকলে আর গুরুগম্ভীর কোন আলোচনা সভায় গুটিকতক মানুষের আলোচনায় আটকে থাকলে আমরা কিছুতেই এইসব মারাত্মক ঘটনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবো না! একজন খুনির মধ্যে অথবা... অথবা একজন ধর্ষক, হ্যাঁ এই পৃথিবীর একজন মানুষের কুৎসিততম এই কাজের উপরেই আলোকপাত করতে চাই আমি। কবে, ঠিক কিভাবে এই মারাত্মক কাজের প্রেরণা, হ্যাঁ সচেতনভাবেই প্রেরণা কথাটা ব্যবহার করলাম; প্রেরণা তো ‘সু’ অথবা ‘কু’, দু’রকমই হতে পারে, তাই না! তবে একটা ধারনা আমার মনে তৈরি হয়েছে আর সেই ধারণাটাই আমি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। সেটা হলো- হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যখন দলবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করল, যখন পুরুষ নামক প্রাণীরা দেখলো শারীরিকভাবে মেয়ে জাতীয় প্রাণীরা তাদের তুলনায় বেশ খানিকটা দুর্বল, যদিও তখনকার মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, তখন কাজের কোন ভাগাভাগি ছিল না। তখন সবাই মিলেই সব কাজ করতো। সব রকম কাজই মেয়েরাও একসাথে করতো। তবুও তুলনায় দুর্বল হওয়ার দরুন জমিজমা, গরু-ছাগল ইত্যাদির মতো নারীও ধীরে ধীরে হয়ে উঠল পুরুষের সম্পত্তি। আলাদা আলাদা গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর দলপতি গায়ের জোরে একাধিক নারীকে দখলে রাখতে শুরু করলো। এরপরে এলো বহুবিবাহ প্রথা। অধিকার ফলানোর মনোবৃত্তি আর আধিপত্য বিস্তারের মনোভাবই এই সমস্ত প্রথার উৎস। এই ধরনের মানসিক বিকার থেকেই ‘ধর্ষণ’ নামের একটা কুৎসিত ব্যাধির উৎপত্তি। ধর্ষণকারী ব্যক্তি ধরেই নেয়, যেহেতু একটি মেয়ে, পুরুষের থেকে সচরাচর শারীরিকভাবে দুর্বল, তাই তার প্রতি যেকোনো রকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ছাড়পত্র, একমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণেই সে জন্মসূত্রে লাভ করেছে! 
ধর্ষণের পর চরম নির্যাতন করে মেয়েটিকে মেরে ফেলার উদাহরণও দেশে-বিদেশে অজস্র রয়েছে। যে মারা গেল, সে তো চিরকালের জন্যই এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল; মহামূল্যবান এক প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল; কোনভাবে, কোন কিছু দিয়েই এই ক্ষতিপূরণ হয় না, হতে পারে না। আর যারা অত্যাচারিতা, ধর্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকে তাদের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়! পরিবার, সমাজ, স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল অথবা থানা, কোর্ট- সব জায়গাতেই সে যেন এক হেঁটে চলে বেড়ানো জীবন্ত বিজ্ঞাপন - অসম্মান আর লজ্জার! শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তার মনও এই আঘাতে একেবারে বিকল হয়ে যায়। সমস্ত হিসেব তার গুলিয়ে যায়। এতদিনের চেনা পৃথিবীটা তার কাছে একেবারে অচেনা হয়ে যায়। ‘বিশ্বাস’ শব্দটাই তার কাছে সবথেকে অবিশ্বাসী শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। চরম দুর্ঘটনার পূর্ববর্তী এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী মানুষটা সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যায়! এই আঘাত তার জীবনকে একটা চরম সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। যারা এই কাজটা করে, সেই ধর্ষকরা, তারা কি কখনো এই কাজ করার আগে তাদের বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান এমনকি নিজের কথাও কি  ভাবে না! তাহলে আমি যে একটু আগে লিখেছিলাম, আত্মা যদি রোগগ্রস্ত হয়, তাহলে তার চিকিৎসা কি করে হবে? যে আত্মা সবার মধ্যে রয়েছে, সেই আত্মাকে না চিনতে পারা, সেই চেতনার অভাবকেই আমি বলছি রোগ! এই উপলব্ধি যখন ভেতরে আসবে, আত্মা যদি সর্বব্যাপী এক শক্তি হয়, আর সেই শক্তির কিছু অংশ যদি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে, আর সেই শক্তি মানুষের সব কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করলে, মানুষ আর একজন মানুষের চরম অসম্মতিতে তার উপর অত্যাচার, নির্যাতন এমনকি তাকে হত্যা করার মত মারাত্মক ঘটনা ঘটাতে পারত না। পারস্পরিক সম্মতিতে ও ভালবাসায় পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি নারী-পুরুষের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠছে তা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুন্দর সম্পর্ক। ভালোবাসার ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা জীবনদায়ী, প্রাণবাহী এবং মানুষের জীবনিশক্তির অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে আর প্রেমহীন, ভালবাসাহীন নিষ্ঠুর নির্যাতন, লালসাভরা সম্ভোগের ইচ্ছা আর একখণ্ড মাংস ছিঁড়েফুঁড়ে নিজের আধিপত্য কায়েম করার উন্মত্ততা শুধু যে কয়েকটা জীবনকে নষ্ট করে দেয় তাই নয়, কয়েক ধাপ পিছিয়ে দেয় মানব সভ্যতার উত্তরণকে আর ব্যথিত করে বিশ্বসৃষ্টিকর্তাকে, কয়েক মুহুর্তের জন্য হয়তো তিনিও ভাবতে বসেন, তাহলে কি তার হিসেবে কোন ভুল ছিল? ধীরে ধীরে মানুষকে বনমানুষের স্তর থেকে আজকের এই অতি সুসভ্য মানুষের স্তরে তুলে আনা কি উচিত হয়নি? ‘বুদ্ধি’ নামক অতি শক্তিশালী এক অস্ত্র কি তাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত হয়নি? আর ব্যথিত হয় এই পৃথিবী। যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষের প্রত্যেকটি কাজের দায়ভার বহন করে চলে, তা সে সৎ কাজ হোক বা অসৎ। অপাপবিদ্ধা পৃথিবী যখন এই চরম ঘৃণ্য ও পাপের কাজের দায়ভার বহন করে, হয়তো এই কথা ভেবেই তখন তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে যে, দস্যু রত্নাকরের, মানুষ হত্যার মতো পাপ কাজের দায় কেউ নিতে চায়নি! না তার বাবা-মা, না তার স্ত্রী-পুত্র। অথচ এই কাজ সে করত তার বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণের জন্যই। আর এই পৃথিবীর, কোন মানুষের কাছেই কিছু চাওয়ার নেই, বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা নেই কারোর কাছ থেকে, অথচ প্রতিনিয়ত নীরবে তাকে এই পাপের ভাগ বহন করে চলতে হচ্ছে! এই চরম ঘৃণ্য অপরাধীকে আমৃত্যু জেলে বন্দি রেখে অথবা মৃত্যুদণ্ড দিয়েও এই অপরাধে তেমন ভাবে রাশ টানা গেছে কি? প্রতিদিনই খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পাতায় এই ধরনের খবর আমরা দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি। একমাত্র তখনই এই চরম ঘৃণ্য কাজ করা থেকে বিরত হবে মানুষ, যখন সে বুঝবে, অপ্রেমে নয় প্রেমে, ভালোবাসাহীনতায় নয় ভালোবাসায়, চরম আপত্তিতে নয় স্বেচ্ছায় পরম আনন্দে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা যে শুধু তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককেই পূর্ণতা দেয় তা নয়, এগিয়ে নিয়ে যায় মানব সভ্যতাকেও।
আর একেই আমি বলতে চেয়েছি চেতনা প্রাপ্তির মাধ্যমে আত্মার রোগমুক্তি ঘটা।