মনের মিল যেখানে রয়েছে, সেখানে সম্পর্ককে বলা হয় মানসিক সম্পর্ক, আত্মায়-আত্মায় মিল থাকে যে সম্পর্কে, সেই সম্পর্ককে বলা হয় আত্মিক সম্পর্ক আর রক্তের সম্পর্ক যেখানে দু’জন মানুষকে বন্ধনে বেঁধে রাখে, তাহলে সেই সম্পর্ককে আমরা কি নাম দেব? রক্তিম সম্পর্ক! হ্যাঁ, হতেই পারে! আত্মিক সম্পর্ক তখন হয়, একটি মানুষের সাথে যখন আলাপ-পরিচয়, জানা, চেনার পরে যখন দুটি মানুষ আস্তে আস্তে কাছে আসে;পরস্পরের অভ্যাস, ভালোলাগা, মন্দলাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে খুব সহজেই বুঝে ফেলে, এমনকি মুখ ফুটে না বললেও একে অপরের নীরব ভাষায় অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারে, তখনই তৈরি হয় সেই আত্মার সম্পর্ক, যা আসলে কোন রক্তের সম্পর্ক বা কোন জানা চেনার উপরে নির্ভর করে না। নির্ভর করে দুটো মানুষের পরস্পরকে কোন একটা অমোঘ মুহূর্তে আবিষ্কারের উপর! ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে যেমন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের পর সেই কালো মেঘ সরে গিয়ে এক ঝলক নরম সূর্যের আলো এই পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে, ঠিক তেমনই একজন মানুষের আত্মায় ছায়া পড়ে আর একজন মানুষের, আর তখনই আত্মিক বাঁধনে বাঁধা পড়ে দু’জন মানুষ।
এই আত্মার সম্পর্ক বা আত্মিক সম্পর্ক- যেকোনো দুটি মানুষের মধ্যেই হতে পারে, তা সে তারা নারী-পুরুষ হোক, দুজন নারী হোক অথবা দুজন পুরুষই হোক। অন্যদিকে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ কারণ সেই সন্তানের এই পৃথিবীতে আসার উপলক্ষ্য তার বাবা-মা। ইংলিশে একটা কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ব্লাড ইজ থিকার দ্যান ওয়াটার। তর্কের খাতিরে একথা মেনে নিলেও এটা আমরা প্রায় সবাই জানি, রক্তের বিভিন্ন উপাদানের ফলে রক্তের ঘনত্ব যথেষ্ট হলেও, জলও কিন্তু খুব সরল কিছু পদার্থ নয়। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মত দু’দুটো গ্যাসীয় উপাদানের যোগফল এই জল।
যাইহোক, এটা বিজ্ঞানের বিষয়, প্রসঙ্গক্রমে আমাদের আলোচনায় তার একটা ঝলক উঠে এলো। রক্তের ঘনত্বের জেরে যে সব সম্পর্কই অতি ঘন ও নিবিড় হয়ে উঠবে, সব সময়ে কিন্তু মোটেই তা হয়না ! হয় যেমন, আবার তার বিপরীত উদাহরণও কিন্তু অজস্র আছে। একটা সময় আমরা অত্যন্ত নিন্দার সুরে বলতাম, যে বাবা-মা কে বয়স হলেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়াটা একান্তভাবেই পাশ্চাত্য রেওয়াজ। প্রাচ্য বা বলা ভালো ভারতবর্ষের রীতি, নীতি, মূল্যবোধ এ কে সাপোর্ট করে না! কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই শুনতে পাই অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের শেষ সম্বলটুকু হাতিয়ে নিয়ে তাদের সন্তানরা, তাদেরকে রাস্তায় বের করে দিয়েছে, তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে অথবা কোন অসহায় বাবা কিংবা মা কোর্টে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আর্জি জানায়, যে বাড়ি তারা তৈরি করেছিলেন তাদের উপার্জনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, ওই বাড়িতেই তাদের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কাটিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন, আর ঠিক সেই কারনেই কেউ বা বড় সাধ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন শান্তিনিকেতন, কেউ বা নাম রেখেছিলেন ভালোবাসা আবার কেউ বা নাম রেখেছিলেন সুখনীড়! এই নামগুলো তো শুধু নাম নয়, বাড়ি তৈরীর সময় ইট, কাঠ, লোহা, সিমেন্টের সঙ্গে তারা ঢেলে দিয়েছিলেন তাদের পরম আকুতি, যে একসাথে সবাই মিলে যাতে এই বাড়িতে থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের সেই সাধ পূর্ণ হয় না। অচিরেই ভেঙে যায় স্বপ্ন।
ওয়ান ফাইন মর্নিং এ নয়, ঘন কালো মেঘে ঢাকা সকালে স্বপ্নের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ভাঙ্গা আয়নায় তারা দেখে, নিকেতন আছে কিন্তু শান্তি যেন কাউকে খুজতে চলে গেছে, কোথায় তা না জানিয়েই! নীড় পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সুখ নামের সোনালী রঙের মায়াবী পাখিটা অজানা নিরুদ্দেশে মেলে দিয়েছে তার ডানা আর ভালোবাসা? ইট, কাঠ, পাথর, সিমেন্ট, লোহায় পোক্ত বাসাটা রয়ে গিয়েছে। ভালো চলে গিয়েছে চিরঘুমে। সেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হওয়ার সময় সেই বাবা কিংবা মায়ের কি একবারও মনে হয় না যে, এই বাড়ির নেমপ্লেটে হয়তো কালই লেখা হবে মন্দবাসা। আর তাই তারা হাতজোড় করে জানান তাদের অপরাধ শুধু তো এইটুকুই যে তারা তাদের স্বোপার্জিত অর্থে তৈরি করা বাড়িতে এই জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিলেন, হয়তো ছোট্ট একফালি বারান্দায় শীতের সকালে উষ্ণ রোদের আদর তারা সারা গায়ে মেখে নিয়ে অথবা গরমকালে সারাদিনের অসহ্য ছটফটানির পর পড়ন্ত বিকেলে দুই পড়ন্ত বেলার মানুষ তাদের ফেলে আসা দিনের ভিডিওয় তাদের M.E.D(এম.ই.ডি) অর্থাৎ Mental Earnest
Desire Screen (মেন্টাল আর্নেস্ট ডিজায়ার স্ক্রীন) এ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে পারতেন, যতক্ষণ খুশি, যতবার খুশি! এইটুকুই শুধু তারা চেয়ে ছিল। সেটা কি অপরাধ? না অপরাধ নয়। মানবিক দিক দিয়েও যেমন এই চাওয়ায় কোন অপরাধ নেই, তেমনি পৃথিবীর কোন কোর্ট এই চাওয়াকে অসম্মান করতে পারে না। এই বাবা মায়েদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন থাকবে পৃথিবীর সব কোর্ট- লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টের আর ইন্টার্নেশনাল কোর্টেরও।
তবে এইসবের ঊর্ধ্বে, বলা যায় একেবারে উর্ধতম কোর্ট রয়েছে- তা হল দি আল্টিমেট কোর্ট অফ মাদার আর্থ। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবী মায়ের আদালত! খুব অবাক হচ্ছেন, তাই না! এই প্রসঙ্গে আলোচনা আর একটু এগোলেই আশা করি আমি আপনাদের এই অবাক ভাবটা কাটিয়ে দিতে পারবো! এই আদালতে বাদী- প্রতিবাদী বলে কোন আলাদা আলাদা পক্ষ নেই। এখানে সবাই একটাই পক্ষে, আর তা হলো নির্বিবাদী পক্ষ। এই আদালতে গীতা, কোরাণ বা বাইবেলে হাত রেখে সত্যবাদিতার প্রমাণ দিতে হয় না! এই আদালতে শুধু বুকে হাত দিয়ে পৃথিবী মায়ের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় পৃথিবী- মায়ের, আর তাহলেই সব কথা বলা হয়ে যায় নিঃশব্দেই, আর পৃথিবী- মাও সব শুনে নেন নিঃশব্দেই। আর এই আদালতের একমাত্র, না, না- যা ভাবছেন তা নয়- কোন উকিল তো এই আদালতে কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ঐ যে বললাম, এখানে একটি মাত্রই পক্ষ। হ্যাঁ, তাই এখানে আমি হচ্ছি একমাত্র মুখপাত্র-কার জানেন? এই পৃথিবী- মায়ের। এখানে কাউকে দোষারোপ করা হয় না। এখানে শুধু বলা হয়। ভালোবাসার সঙ্গে। তাই সেই ভালবাসাই আমাকে বলে দিচ্ছে বলতে এই কথাটা, যে বাবা-মায়েদের এই পরিণতি, সন্তানদের এই ধরনের অ-মানবিক আচরণ কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়। কিন্তু, হ্যাঁ কিন্তু এই সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই- এই অন্যায়ের বীজ কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরাই বহন করে চলেছি, আর হ্যাঁ, সেই রক্তেই, যে রক্তের সম্পর্কেই আমরা কেউ কারোর বাবা, কেউ কারোর মা আবার কেউ কারোর ভাই- বোন। এই সবই হয় জন্মসূত্রে। একই পরিবারে জন্মসূত্রে। এই জন্মসূত্রে যদি আত্মীয় হয়, রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের সূত্রে, এই বিশাল পৃথিবী-পরিবারের একজন সদস্য হওয়ার দরুন এই পৃথিবীর সব মানুষ কেন পরস্পরের আত্মীয় হবে না আর এই পৃথিবী কেন আমাদের সর্বোত্তম আত্মীয় হবে না!
এই পৃথিবী তো আমাদের পরম আত্মীয়। এই মানুষ জাতি কে তিনি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটু একটু করে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। তাকে এই উত্তরণের পথে যুগিয়ে গেছেন অজস্র উপাদান। পৃথিবীর বুকে থাকা সর্ব রকমের সম্পদ মানুষ পেয়েছে তার এই সভ্যতার শিখরে পৌঁছানোর জন্যে। কিছু জমি, বাড়ি বা অর্থ যদি জন্মসূত্রে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী প্রজন্ম, পাওয়ার পরেও সেই পূর্বপুরুষ বা তার বাবা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা না থাকে, তাদের প্রতি অতি নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করে, তাহলে সেই পাপ কাজের দায়িত্ব এই পৃথিবীতে বর্তমান এবং যারা এই পৃথিবীতে অনেক অনেক বছর আগে এসেছে, ও চলে গেছে তাদের সবার উপরেই এই দায় বর্তায়। কখনো এই কথাটা আমরা একবারের জন্যও ভেবে দেখিনা যে পৃথিবীতে আমরা যদি জন্ম গ্রহণের সুযোগটাই না পেতাম, তাহলে জ্ঞান হওয়ার পর যাদের আত্মীয় বলে জেনেছি, যাদের আনন্দে আনন্দ পেয়েছি, দুঃখে দুঃখ পেয়েছি, ভালোবেসেছি, একসাথে খাবার ভাগ করে খেয়েছি, বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি- এই সুযোগ আমরা কি করে পেতাম, যদি এই পৃথিবীতে আমরা আসার সুযোগটুকুই না পেতাম। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে একেবারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত যদি এই পৃথিবী আমাদের আগলে না রাখত তাহলে কি হতো আমাদের?
কিন্তু কোনদিন কোন মানুষ এই কথা ভেবে দেখেনি। এই পরমাত্মীয়ের প্রতি এতোটুকু ভালোবাসা যখন আমাদের মনে আসেনি, তার প্রতি এতটুকু আবেগ বা সহানুভূতি আমাদের মনে যখন তৈরি হয়নি, সেই শিক্ষা যখন উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা পাইনি, তখন বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করবো, তাদের প্রাপ্য সম্মান দেখাবো- এতটা আশা করা বোধ হয় বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! কথায় কথায় আমাদের বলা হয়, পিতৃঋণ আর মাতৃ ঋণ শোধ করা যায় না। একেবারে ঠিক কথা, কিন্তু যে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে পৃথিবী থেকেই সবকিছু নিয়ে, সন্তানদের বুক দিয়ে আগলে রাখে বাবা- মা, তাহলে সেই পৃথিবীর ঋণও কোনভাবেই কি শোধের চিন্তা করা যায়? এর উত্তর- না, না এবং না। এই কথা কিন্তু বোঝা বা বোঝানোর চেষ্টা, দুটোর একটাও কোনদিনই করা হয়নি। এই মহত্তম পৃথিবীর মহত্তম স্বার্থত্যাগের কথা যদি পুরুষানুক্রমে ভাবতে পারতাম এবং গেঁথে দিয়ে যেতে পারতাম পরবর্তী প্রজন্মের মনে, তাহলে বাড়ি, গাড়ি, ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স - এসবের জন্য বাবা- মাকে তোষামোদ করে চলা আর সেই সমস্ত জিনিস হাসিল হয়ে গেলে বাবা-মাকে জোর করে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া - কোনটাই হতো না। যদি এই উপলব্ধি ভেতরে তৈরি হয়ে যেত, এই পৃথিবী আমাদের পরম আত্মীয়, আমাদের সব চাওয়া-পাওয়াকেই সে হাসিমুখে মেনে নেয় এবং বিরামহীনভাবে তা মিটিয়ে যায়, তাহলে আমরা কখনোই বাবা-মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করতে পারতাম না। তখন আমরা তাদের এই পৃথিবী মায়েরই প্রতিনিধি ও প্রতিরূপ বলে গ্রহণ করতাম। একবার যদি মনে হতো এই কথাটা, যে আমাদের আচরণে মা- বাবাও তো কোন সময় বিরক্ত হয়, রাগ করে এমনকি সম্পত্তি সন্তানকে হস্তান্তর করার সময় তাকে বিভিন্ন শর্ত দেয়, সেই সন্তান বাবা-মাকে দেখবে সেই প্রত্যাশা রাখে এবং বহু সময় দেখা যায়, সম্পত্তি ঠিকভাবে দেখাশোনা না করতে পারার জন্য বা সম্পত্তির অপব্যবহার করলে মা-বাবা সেই সন্তানকে সম্পত্তি থেকে শুধু বঞ্চিতই নয়, তাকে ত্যজ্য সন্তানও ঘোষণা করে দেয়।
অথচ এই পৃথিবী, যে আসলে সব সম্পত্তির মালিক কিন্তু কোন প্রাণীকেই তো নয়ই, এমনকি মানুষ, যে মানুষ তার সম্পত্তি চূড়ান্তভাবে শুধু ভোগ ও উপভোগই নয়, অত্যন্ত অপ্রয়োজনে, শুধুমাত্র নিজেদের ইচ্ছে, খেয়াল, ভালোলাগা আর বিলাসিতার মনোভাব চরিতার্থ করার জন্যে এই পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য - ও সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে, সেই চরম অন্যায়ের জন্যও কিন্তু মানুষের প্রতি তার ব্যবহার এতোটুকু বদলায় না! প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মানুষ নামক অকৃতজ্ঞ জীবদেরই সে উজাড় করে দেয় তার ভান্ডার আর আমরা, এই মানুষেরা মনে করি এতো আমাদেরই প্রাপ্য। এই পৃথিবীতে জন্মেই আমরা ধন্য করেছি পৃথিবীকে! এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা শারীরিক সৌন্দর্য, নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ- যা কিছু অর্জন করি, তাতে কি এই পৃথিবীর কিছু যায় আসে? আমাদের পরস্পরের প্রতি প্রেম- অপ্রেম, তীব্র ঘৃণা অথবা নিবিড় ভালোবাসা- এর কোনটাই কি পৃথিবীকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারে? না, একেবারেই না। আমাদের সমস্ত কার্যকলাপের পরম উদাসীন এক সাক্ষী ও দ্রষ্টা সে। তার এই বিপুল সম্পত্তির ব্যবহারের জন্য সে না দেয় কোন শর্ত আর অত্যন্ত ক্ষতি যে করে, সেই জনকেও সে ত্যজ্য করেনা। রক্তের সম্পর্ক সম্পর্কিত যে সম্পর্ক তা অনেক সময়ই পরস্পরের প্রতি লোভ, ঘৃণা আর হিংসায় রক্তাক্ত সম্পর্কে পরিণত হয়। কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে পৃথিবী মানুষের হাতে প্রতি মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়েও কখনোই প্রতিহিংসার কথা ভাবে না। তা যদি ভাবতো তাহলে এই পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ নামক জীব যে কোনোদিন, যেকোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেত। পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক রক্তহীন, কিন্তু অ্যানিমিক রিলেশন নয়; এই পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রকৃত ভালোবাসার, পরম আত্মীয়ের সম্পর্ক। কিন্তু এই সামান্য ছোট্ট কথাটুকু এত এত বছর ধরে কারোর মনে কেন আসেনি, এটা ভাবলে একটু আশ্চর্যই হতে হয়! এই বোধ, এই চেতনা যদি আমাদের মনে একবার ছাপ ফেলে, তাহলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্ক বলে কোন সম্পর্ক ছোট কোন গন্ডিতে আবদ্ধ থাকবে না।সমস্ত সম্পর্কই পরম আত্মীয়ের সম্পর্কে পরিণত হবে। কে কোন পরিবারে জন্মেছে, কে কার সঙ্গে জন্মসূত্র সম্পর্কিত, এইসব, কোন সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না।
সম্পর্কের সূত্র বাঁধা থাকবে সবআত্মীয়ের বড় আত্মীয় এই পৃথিবী-আত্মীয়ের সাথে আর সেই সূত্রেই বাঁধা পড়বে এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। সবথেকে যে বড় আত্মীয় তার কাছ থেকে ত্যাগ, স্বার্থহীনতা এবং কোনো প্রত্যাশা না রেখেই শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা- এই সমস্ত বিষয়ে আমাদের ভাবনায়, আমাদের চেতনায়, আমাদের ব্যবহারিক জীবনে ছাপ ফেলবে, তখনই আমরা আমাদের সন্তানদের প্রতি বা সন্তানরা বাবা- মায়ের প্রতি কি আচরণ করবে, তা অন্তর থেকে উপলব্ধি করবে। শুধু এইটুকুই আমাদের মাথায় এলেই হবে, জন্মসূত্রে আত্মীয়তাকেই আমরা পরস্পরের প্রতি আত্মিক সম্পর্কের প্রথম সোপান বলে ধরে নিতে পারব, যখন একেবারে এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমরা অর্জন করতে পারব যে জন্মসূত্রে এই পৃথিবীতে আমরা এসেছি বলেই পৃথিবী আমাদের জন্মসূত্রে পরম আত্মীয় আর এই বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মেছি বলেই আমরা সেই জন্মসূত্রে পরস্পরের আত্মীয়, আমরা এই এক ও অদ্বিতীয় পৃথিবী-পরিবারের সদস্য। বিশ্বের কোন প্রান্তে কোন অত্যন্ত অভিজাত পরিবারে কেউ জন্মগ্রহণ করেছে অথবা অত্যন্ত দরিদ্র, অখ্যাত পরিবারে কেউ জন্মগ্রহণ করেছে- এই বিষয়গুলো অনেক পেছনে চলে যাবে, কারণ মানুষ তখন নিজেই উপলব্ধি করবে, যে পৃথিবী-পরিবারে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেই পৃথিবী- আমাদের প্রত্যেকের জন্যই সূর্যের আলো,নদীরজল, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা অজস্র-স্থান সাজিয়ে রেখেছে। তার খনিজ সম্পদ, তার প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার- সবকিছুই সে উজাড় করে দিয়েছে আমাদের-জন্য। এ আমাদের সবার। গায়ের জোরে সেই সম্পদ বেশি বেশি ছিনিয়ে নেওয়া, ভোগ দখল করা, ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার, যেমন কোন পরিবারের একজন সদস্য গায়ের জোরে, ক্ষমতায় পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে ছলে- বলে- কৌশলে যেমন পরিবারের সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চায়। যেদিন সত্যি সত্যি আমরা মনে করতে পারবো, যে সম্পত্তি আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই বা নিজেরা অর্জন করি বলে মনে করি, আসলে সেই সম্পত্তির এক কনাও আমাদের নয়, সব সম্পত্তি এই পৃথিবীর এবং সে একেবারে ফ্রী লিজ্ দিয়েছে সেই সম্পত্তি ভোগ করার জন্যে, তখন আমরা নিজেরাই অনুভব করব যে লিজ্ পাওয়া সম্পত্তি ভোগ করার সঙ্গে তাকে উপযুক্ত ভাবে দেখভাল করার ব্যাপারটাও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর লিজ্ পাওয়া সম্পত্তি কোন অবস্থাতেই হস্তান্তরিত হয়না বা কাউকে দান করা যায় না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেই সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এখানে একমাত্র ও প্রকৃত মালিক যে পৃথিবী, সেই পৃথিবী- মালিক কখনোই তার সম্পত্তি ফিরিয়ে নেওয়ার কথা যেমন বলেনি তেমনি তার সম্পত্তি আমরা নিজেদের বলে দাবি করতেও পারি কি? একখণ্ড জমি নিয়ে দখলদারির মামলা চলে বছরের পর বছর, মামলা গড়িয়ে যায় এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে, দু’ পক্ষেরই অনেক অর্থ খরচ হয় এবং একটা সময় যখন মীমাংসা হয়, তখন দেখা যায় বিজয়ী ও বিজিত, দু’ পক্ষই অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে! কিন্তু আমি শুরুতেই যে কোর্টের কথা বলেছিলাম, সেই আল্টিমেট কোর্ট অফ্ মাদার আর্থ- এখানে কিন্তু শুধু একটা মাত্র নোটিশ ঝোলানো থাকে কোর্টের বাইরের নোটিশ বোর্ডে আর সেটা হল-
রক্তে নয়
আত্মীয়তা গড়ে ওঠে অনুভবে
থেকে যাবে পৃথিবী-আত্মীয়
বাকি সব আজ বা কাল
দূরে যাবে।