ক্ষুধা। হাঙ্গার। ভুখ। কল ইট, বাই এনি নেম, ইট ডিমান্ডস, ফুড অথবা খাদ্য,ইয়া তো খানা। ব্যাপারটা একই। এই খাদ্যের অভাবে সারাবিশ্বে কত মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে আর তার মধ্যে কতজনই বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা শিশু, তার একটা মোটামুটি হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেয় বটে, কিন্তু প্রকৃত হিসেব কি কোনদিনও পাওয়া যাবে? বিখ্যাত ব্রিটিশ বাগ্মী, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন- ম্যান ইজ এন এনিম্যাল দ্যাট কুক্স হিজ ভিটলস। অর্থাৎ মানুষ সেই প্রাণী, যে নিজের খাদ্যবস্তু রান্না করে খায় অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীর একেবারে প্রথম ও প্রধান চাহিদা হল খাবার। এই খাবারের জন্য মানুষ করতে পারেনা, এমন কোন হীন কাজ নেই। এই খিদের কাছে নতজানু এই পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় মানুষ এমন কাজ করে বা করতে বাধ্য হয় যে এই খিদে নামক বস্তুটা না থাকলে কখনোই সে ওই কাজ করতো না। বড় অদ্ভুতভাবেই এই খিদে বশ্যতা স্বীকার করায় আমাদের। আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বজুড়ে এই খিদে এবং খাবার নিয়েই অজস্র গান, কবিতা, ছবি, সাহিত্য, সিনেমা রচিত হয়েছে। অনেক সময় তা বিশ্বের দরবারে বহু চর্চিত, আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে, বহু সম্মানেও ভূষিত হয়েছে; কিন্তু নিদারুণ এই সমস্যায় তাতে কোনো সমাধান হয়েছে কি?
এই সমস্যার প্রকৃত বাস্তব সমাধান হলো মানুষের শিক্ষা ও কর্মক্ষমতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া আর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা প্রান্তিক মানুষের হাতে নগদ অর্থের যোগান আসা। গরিব মানুষের হাতে তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকলে তাদের যে চাহিদা, তার সাথে যদি তারা সামঞ্জস্য রাখতে না পারে, জীবনধারণের জন্য নূন্যতম যে চাহিদা সেটুকু যদি তাদের আয়ত্তে না থাকে, তাহলে সমগ্র অর্থনীতির উপরেই ভয়ংকরভাবে সেই চাপ পড়বে আর ভেঙে পড়বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। খাদ্যের সঙ্গে কর্মহীনতার একেবারে সরাসরি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। আর কর্মহীনতা যখন ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা দেয় সমাজে, তখন নানা রকম খারাপ কাজও সাংঘাতিক ভাবে বেড়ে যায়। বেড়ে যায় অপরাধমূলক কাজ। আসলে সবকিছুকে বশ করা যায়, এই ক্ষিদেকে নয়। কোনটা ভালো কাজ, সঠিক কাজ আর অত্যন্ত অন্যায় কাজই বা কোনটা, সেই যুক্তি, বিবেক বা বোধটাই খিদের সময়ে কাজ করেনা। অজস্র উক্তি আর প্রবাদ তৈরি হয়েছে খিদেকে ঘিরে। এই মুহূর্তে তার দুটো মনে পড়ছে। প্রথমটা বাংলায়- ‘খিদে পেলে বাঘেও ধান খায়’ আর দ্বিতীয়টা ইংরাজীতে- ‘হাঙ্গার ইজ দা বেস্ট সস্’! দুটো প্রবাদ বাক্যের জন্ম দুটো আলাদা দেশে, আলাদা পরিবেশে, আলাদা ভাষায়, অথচ কি আশ্চর্য মিল দুটো প্রবাদ বাক্যের মধ্যে। মনে হয় যেন একটা আর একটার অনুবাদ! আসলে ব্যাপারটা তো তাই।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত ক্ষুধার্ত মানুষকে এক করে দেয় ক্ষুধা নামের এই কমন ফ্যাক্টর। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো কিছু খবর আমাদের চোখে পড়ে অথবা আমাদের কানে আসে, কিন্তু চায়ের টেবিলে দামি চায়ে চুমুক দিতে দিতে অথবা আলোচনার বিভিন্ন প্রসঙ্গের মধ্যে এই প্রসঙ্গও ছুঁয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো প্রভাব ফেলে না এই খবর আমাদের জীবনে। আসলে বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া করোনা ভাইরাস এর মারন শক্তি স্পেয়ার করে না কাউকেই। ধনী থেকে অতি-ধনী অথবা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম, করোনার অতি প্রিয় শিকার সব অবস্থার মানুষই। বিশ্বমান্য থেকে ন্যূনতম মানুষকে এই কোভিড-১৯ ভাইরাস তার বিশ্বজোড়া কালো জাল পেতেছে ছেঁকে তোলার জন্যে। রুই, কাতলা বা চুনো-পুঁটি কেউ তার কাছে অচ্ছুত নয়! তাই তাকে নিয়ে এত ভয়, এত তৎপরতা কিভাবে তাকে শায়েস্তা করা যায়! কিন্তু খাদ্যের অভাবে মৃত্যু তো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের ব্যাপার! এখানে তো সচ্ছল মানুষের, ধনীর কোন ব্যাপারই নেই। তাদের সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোন কাজ তো এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকে না! এটাতো একান্তভাবেই গরিবের সমস্যা। সারা বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অতি তুঙ্গে চলেছে তৎপরতা, কতদিনে প্রতিষেধক বের করা যায়, কত তাড়াতাড়ি - এই মারণ রোগকে প্রতিহত করার জন্য কিন্তু ক্ষুধা নামের অতি মারণ এই ভাইরাসকে ঠেকানো নয়, চিরনির্মূল করার উপায় ছিল এবং আছে আমাদেরই হাতে। সারা বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষকে জনগণনা বা ভোট গণনার শুধুমাত্র সংখ্যা বলে হিসেবে না ধরে সৎ ইচ্ছেটুকু নিয়ে প্রত্যেক দেশের সরকার যদি এই কথাটা ভাবতো যে প্রত্যেক মানুষের পেট ভরে খাওয়াটা একেবারে প্রথম ও প্রাথমিক অধিকার, তাহলে ‘অনাহারে মৃত মায়ের বুকের উপর অবুঝ শিশু’ খবরের কাগজে এই ধরনের শিরোনাম বা রাস্তার পাশে অনাহারে মৃত মানুষের ছবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করা ছবি বা কবিতা বের হতো না! পৃথিবীতো তার সমস্ত সম্ভার উজাড় করে দিয়েছে আমাদের খাদ্যের যোগানের জন্য; সবাই মিলে একটু উদ্যোগ নিলেই এই অনাহারে মৃত্যুকে চিরকালের মতো দূর করে দেওয়া যায়।