।। নবম অধ্যায়।।

স্থায়ী বিশ্বশান্তি কিভাবে আসতে পারে, সে কথা আমরা এর আগে আলোচনা করেছি, এইবারে আলোচনা করব সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ এই স্থায়ী বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে কিভাবে সরাসরি উপকৃত হবে। আমরা দুটো কথা খুব আলোচনা করি, একটা হল আত্মসম্মান আর একটা হল- সব মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া। কথাদুটো অসংখ্যবার শোনা কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ নিয়ে আমরা ক’জন ভাবি? প্রথমে আসি আত্মসম্মান নিয়ে আলোচনায়! এই আত্মসম্মান আর পরসম্মান দুটোই কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আত্মসম্মান অর্থাৎ নিজেকে সম্মান আমরা তখনই করতে পারব যখন আমাদের কাছে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানটা খুব স্পষ্ট থাকবে অর্থাৎ আমার কাজকর্ম নিয়ে আমি আমার বিবেকের কাছে খুব পরিষ্কার থাকবো এই কারণে- যে আমার কাজের দ্বারা আমার পরিবার এবং আশেপাশে থাকা মানুষ উপকৃত হচ্ছে কি ! তখন আমাকে আমি মর্যাদা দিতে পারব আর সম্মান করতে পারব কারণ- অন্যের চোখেও আমি একটা সম্মানের দৃষ্টি দেখতে পাবো আর ঠিক সেই কারণেই অন্য মানুষজনকে, সে যে পেশাতেই থাকুক না কেন, তাকে তার প্রাপ্য সম্মান আমি দিতে পারবো। সব ধরনের প্রফেশনকে সম্মান দিতে শিখবো আর সামাজিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হবে। সম্মান করতে পারাটা ঠিক মুখ দেখার মত। কাউকে সম্মান করলে, সেও সেই সম্মান আমাদেরকে দেখাবে আর তাই সম্মান পাওয়া এবং দেওয়াটা পরস্পরের পরিপূরক।
এই স্থায়ী বিশ্বশান্তির কারণে মানুষের মনে সবার আগে আসবে শুভবুদ্ধি ও চেতনা। তখন মানুষের মুখ কতটা সুন্দর বা কুৎসিত সেটা একেবারেই বিচার্য হবে না। কারণ সব মানুষের মুখ হয়ে উঠবে মানবিক। তাই তখন বাজারে হঠাৎ করে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে না! হঠাৎ করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়ে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়বে না, কারণ স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্রকে পৃথিবীজুড়ে কার্যকর করতে গেলে পরপর যে পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাতে মানসিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। যখনই এই কথা আমাদের মনকে নাড়া দেবে, এই পৃথিবী আমাদের সব কিছুর খেয়াল রেখেছে, তাই আমাদেরও উচিত এই পৃথিবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, তার জন্য আমাদের সময়, শ্রম ও অর্থের কিছুটা অংশ ব্যয় করে দূষণমুক্ত রাখা এবং তার সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রাখা, তখনই ক্রমশ আমাদের মনও দূষণমুক্ত, স্বচ্ছ ও সুন্দর হয়ে উঠবে, কেননা এই কথাটা আমাদের মনে আসবে, সুস্থ, সুন্দর ভাবে বাঁচাটা, দূষণমুক্ত পৃথিবীতে বুক ভরে তাজা বাতাস নিয়ে বাঁচাটা আমাদের সবারই অধিকারের মধ্যে পড়ে, তখন মানুষ আর শুধু নিজের লাভের কথা, নিজে আর নিজের পরিবারের মাত্র কয়েকজনের ভালো থাকার কথা ভাববে না। অতি বৃহৎ এই পৃথিবী-পরিবারে জন্মেছি বলে আমরা সবাই সবাইকে একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করব আর ইচ্ছে করে কৃত্রিম সংকট তৈরি যা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আচমকা মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হওয়ার কথা তখন কিছুতেই ভাবব না। এই রকম ছোট ছোট বিষয়ে পরিবর্তন ঘটিয়ে আমূল এক পরিবর্তন আনবে স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র।
নানারকম পুজোর বিসর্জনে তো বটেই, এছাড়াও দেশে-বিদেশে এমন বহু অনুষ্ঠান হয়, তা সে স্পোর্টস ইভেন্ট হোক অথবা কার্নিভাল, কোন দেশ বিশ্বকাপ ফুটবল জিতুক অথবা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল কিংবা সারা বিশ্বজুড়ে বড়দিনের উৎসব অথবা ডিসেম্বরের শেষদিনটায় সারাবিশ্বে উৎসব- এই সমস্ত বিষয়ে উৎসব উদযাপন করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার বাজি পোড়ানো হয়, স্রেফ ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় অজস্র টাকা! শুধুমাত্র ব্যাপারটা মিস ইউজ অফ মানি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এতো গুরুতর হতো না। কিন্তু যে বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত ধোঁয়া এর ফলে উৎপন্ন হয় তা বাতাসকে চরমভাবে বিষাক্ত করে এবং দূষিত করে বায়ুমন্ডলকে। এর ফলে মানুষ যেমন সরাসরি বাতাসের অতিমাত্রায় দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঠিক তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামগ্রিক পরিবেশ। যে শিশুটা সদ্যোজাত বা যে শিশুটা হয়তো কয়েক দিন পরেই জন্ম নেবে এই পৃথিবীতে, সেই শিশুটাও বুকের ভেতর এই বিষ নিয়েই জন্মাবে। এই ভাবে দিনের পর দিন দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এর ফলে আমরা অবচেতনভাবে নিজেদের একটা চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি। আমরা এই চরম বিপদকে ঠেকাতে পারি, যদি সচেতনভাবে এই দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য আমরা সচেষ্ট হই। আমরা এ কথাটা যদি নিশ্চিত ভাবেই উপলব্ধি করি যে এইভাবে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ আমরা কিছুতেই করবো না, শুধু আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের স্বার্থে নয়, যারা আমাদের পরে আসবে তাদের স্বার্থে, তাদের জন্য। আর সেটাই হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের সঠিক কর্তব্য পালন।