।। ষোড়শ অধ্যায়।।

পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষ, আজকের দিনে এই মনোভাবই সবথেকে জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়েই ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একজনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর একজনকে যখন-তখন আক্রমণ করবে, আহত করবে অথবা উল্টো দিক থেকে কারো বক্তব্য  বা মতামত, আমার বা আমাদের মনমত না হলে বা আমাদের বিরুদ্ধে গেলে, সবাই রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তার উপর, এও মোটেই অভিপ্রেত নয়। আমরা পড়ে এসেছি, শুনে এসেছি- কথাতেই নাকি অমৃত ঝরে। তৃষ্ণার্ত একজন মানুষ, শীতল জল পান করে যেমন তৃপ্তি লাভ করে, ঠিক তেমনি একজন মিষ্টি কথাতেও ঠিক একই অনুভূতি হয়। কিন্তু আজ সমাজে মিষ্টি কথার চাষ না হয়ে, হচ্ছে বিষাক্ত কথার চাষ। ‘বাক্যবাণ’ কথাটা বইতে পড়েছি আমরা প্রায় সবাই, আর তখন যদি সবাই সেই কথার মানে বুঝতে পেরে থাকি, আজ কিন্তু আমরা প্রতিমুহূর্তেই পরস্পরকে বাক্যবাণে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি। কারোর কথা অপছন্দ হলেই তাকে  শাসানো,হুমকি দেওয়া অথবা তাকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে নিগ্রহ করা - এগুলো একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং ঘোরতর অন্যায়ও বটে। আর এইভাবেই যদি ঘৃণার চাষ হতে থাকে তাহলে একদিন একটি জাতি,ধর্ম, রাজ্য, দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্যের মত বা বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু সহজাত ভদ্রতা বা সহিষ্ণুতায় আমরা আমাদের পাল্টা বক্তব্য জানাতেই পারি।আলাদা মত, এক বক্তব্যের প্রতিবাদে অন্য বক্তব্য পেশ করা- এ জিনিস চলতেই পারে এবং তা স্বাগতও বটে কিন্তু শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেন কিছু না হয়, এই শুভবুদ্ধিটুকু প্রত্যেক মানুষের কাছেই প্রত্যেক মানুষ আশা করবে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই করবে।
সৎ পথে স্বাভাবিক স্বচ্ছ জীবনযাপন করলে হয়তো সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু  ভোগী ও বিলাসী জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। একথাটা আজ এক শ্রেণীর মানুষ ভীষণভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। উদ্দাম জীবনযাত্রা,যেখানে ছড়িয়ে আছে অজস্র আপাতমধুর প্রলোভন, সেই পথে চলতে গেলে প্রতিমুহূর্তে চাই অজস্র টাকা। বেহিসেবি টাকা । সেই টাকা রোজগার এর জন্যই প্রচুর মানুষ জড়িয়ে পড়ছে একের পর এক অপরাধমূলক কাজে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুপাচার, নারীপাচার, মাদক চোরাচালানের মতো মারাত্মক অপরাধমূলক কাজকর্ম। এই কাজ কর্মের দ্বারা সাময়িকভাবে হয়তো হঠাৎ করে অনেক অর্থ রোজগার করা যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পাপের শাস্তি হয় মারাত্মক। কারণ আমি আগে অনেকবার বলেছি, এখন আরো একবার বলছি, এই পৃথিবী অপাপবিদ্ধা; তাই এহেন জঘন্য পাপ কাজ পৃথিবী কিছুতেই মেনে নেয় না। শুধুমাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। ঐ কথাটাই সত্যি হয়ে উঠবে- পাপের বেতন মৃত্যু। যে শিশু, যে নারী ঐ সমস্ত পাচারকারীদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অথবা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিকার হয়ে যায়, সেই সমস্ত শিশু ও নারীদের কিন্তু এই পৃথিবীতে নিজেদের পরিবারের সাথে হেসে, খেলে, আনন্দে কাটাবার সম্পূর্ণ অধিকার ছিল বা আছে। এই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকার তাদের ছিল বা আছে। তাদের জীবনটা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, শিশুদের শৈশব  নিংড়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়ে অর্থ রোজগার করানোর অতি ঘৃণ্য চক্রান্তে যারা জড়িত অথবা যে নারীদের স্বাধীনভাবে হেসে, খেলে নিজের জীবনটা চালানোর কথা ছিল এবং এই সমাজকে হয়তো অনেক বড় কিছু দেওয়ার ছিল, তাদেরকে এই অন্ধকারময় জীবনে টেনে আনার চরম শাস্তি তো পেতেই হবে। আর ঐ মাদক চোরাচালানের কারবারিরা এই গোটা সমাজকে একেবারে কালো অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। সমাজের সেরা সম্পদ যুবসমাজ, সেই যুবসমাজকেই  একটা রঙিন স্বপ্নের মোড়কে মুড়ে রাখে, তাদের মেধা, শ্রম, বিবেক, চেতনা সবকিছু এই মাদকের স্রোতে ডুবে যায়। সংসার থেকে, সমাজ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার পর, সেই নেশার উপকরণ জোগাড় করার জন্য অপরাধ করতে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠাঁই হয় কোন সংশোধনাগারে। অর্থাৎ মাদক-চোরাচালানের সঙ্গে সঙ্গে তারা এক শ্রেণীর অপরাধীও তৈরি করে ফেলছে। এই সমস্ত অপরাধ তখনই শেষ হতে পারে, যখন মানুষ অনুভব করবে ভোগ আর উচ্ছৃংখলতার স্রোতে কিছু মানুষের ভেসে যাওয়াটা জীবন নয়। সব মানুষ আনন্দে খুশিতে যখন এই পৃথিবীতে জীবনটা কাটাবে, এই পৃথিবীকে পরম আত্মীয় মনে করবে, পৃথিবীর প্রতি কিছুটা হলেও তাদের দায়িত্ব পালন করবে পৃথিবীকে সুন্দর রাখার জন্যে, একমাত্র তখনই সবাই মিলে ভালো থাকতে পারবো।